০৭ অগাস্ট ২০২৫

আইকিউ কী, এটি কি সত্যিই সাফল্য অনুমান করতে সক্ষম?

মিনহাজুল ইসলাম শান্ত
২৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৬:৩৫
আইকিউ হলো বুদ্ধিমত্তা বা বুদ্ধাঙ্ক নির্ণয়। প্রতীকী ছবি

বুদ্ধিমত্তা কিংবা জ্ঞানের কথা বললে আমাদের প্রথমেই মাথায় আসে আলবার্ট আইনস্টাইন, স্টিফেন হকিংয়ের কথা। সম্ভবত তাঁরাই ছিলেন আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত কিছু প্রতিভাবানদের একজন। তাঁদের নানান আবিষ্কার এবং চিন্তাভাবনার কথা ভাবলেই বোঝা যায়, তাঁদের বুদ্ধিমত্তার স্তর কোন পর্যায়ে ছিল। তাঁদের রেখে যাওয়া সূত্রের মাধ্যমেই আজকের বিশ্ব এই উন্নতি সাধন করতে সক্ষম হয়েছে। তাঁদের বুদ্ধিমত্তার দিকটি বিবেচনা করে অনুমান করা হয় যে উভয়েরই প্রায় ১৬০ স্কোর হবে। যদিও এটি একটি চিত্তাকর্ষক স্কোর, কিন্তু এটি বিশ্বের সর্বোচ্চ আইকিউ হওয়ার কাছাকাছিও নয়। এই আইকিউ বিষয়টির সাথে আমরা কমবেশি সবাই পরিচিত। আমরা বিভিন্ন জায়গায়, বিভিন্ন জ্ঞানী মানুষের আইকিউ নিয়ে কথা বলতে শুনেছি। এখন প্রশ্ন আসতে পারে যে আইকিউ (IQ) কী? আইকিউ স্কোরের অর্থ কী এবং এটি কি গুরুত্বপূর্ণ কিছু?

আইকিউ কী
দুজন ফরাসি মনোবিজ্ঞানী আলফ্রেড বিনেট ও থিওডোর সাইমন ১৯০৫ সালে ফ্রান্সের স্কুলে কম মেধাবী এবং বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত শিশুদের জন্য একটি পরীক্ষার পরিকল্পনা করেছিলেন, যার নামকরণ করা হয়েছিল ‘বিনেট-সাইমন পরীক্ষা’। কোন কোন বাচ্চার স্বতন্ত্র মনোযোগের প্রয়োজন, তা নির্ধারণ করার জন্য তৈরি করা হয়েছে পরীক্ষাটি। মূলত তাঁদের এই পদ্ধতিটি আধুনিক আইকিউ পরীক্ষার ভিত্তি তৈরি করেছে। তাহলে আইকিউ পরীক্ষা কীভাবে কাজ করে এবং তাতে কি বুদ্ধিমত্তার সত্যিকারের প্রতিফলন হয়?

আইকিউ টেস্ট বা আইকিউ পরীক্ষার বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায় বুদ্ধিমত্তা বা বুদ্ধাঙ্ক নির্ণয়। সহজ করে বললে, একজন ব্যক্তির যুক্তিপ্রয়োগ, বিচার অথবা কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর ক্ষমতার পরিমাপ। আইকিউ টেস্টের দ্বারা অনুমান করা হয় কেউ কতটা ভালোভাবে মৌখিক যুক্তি, কাজের স্মৃতিশক্তি এবং চাক্ষুষ-স্থানিক দক্ষতা ব্যবহার করতে সক্ষম। এটি মানুষের মানসিক বয়স ও প্রকৃত বয়সের অনুপাত। মানসিক বয়সকে প্রকৃত বয়স দিয়ে ভাগ করে ১০০ দ্বারা গুণ করলে আইকিউ বা বুদ্ধাঙ্ক পাওয়া যায়। ১৯১২ সালে জার্মান মনোবিদ উইলিয়াম স্টার্ন Intelligence এবং Quotient শব্দজোড়া থেকে IQ শব্দটি তৈরি করেন, যা বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় শব্দ হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে।

আইকিউ নির্ণয়ের সূত্রটি হলো : বুদ্ধাঙ্ক (IQ) = MA/CA×100। এখানে MA মানে মানসিক বয়স (Mental age) ও CA মানে প্রকৃত বয়স (Chronological age)।

প্রথমত মানসিক বয়স বের করার জন্য নির্দিষ্ট বয়সের জন্য নির্দিষ্ট কিছু প্রশ্ন নিয়ে প্রশ্নমালা তৈরি করা হয়। সেই প্রশ্নগুলোর উত্তরের স্কোর ব্যক্তির নির্দিষ্ট বয়সের সাথে ভাগ করে ১০০ দ্বারা গুণ করা হয়। ১০০-কে ধ্রুবক হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু কোনও ব্যক্তি যদি সবগুলো প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারে, তবে তার মানসিক বয়স সেই নির্দিষ্ট বয়সের সমান হবে। যেমন ১০ বছরের শিশু যদি ১০ বছরের জন্য নির্দিষ্ট করে সাজানো প্রশ্নমালার উত্তর সঠিকভাবে দিতে পারে, তার মানসিক বয়স হবে ১০, যা তার প্রকৃত বয়সের সমান। আবার যদি সে ১৩ বছর বয়সের জন্য নির্দিষ্ট প্রশ্নমালার সঠিক উত্তর দিতে পারে, তবে তার মানসিক বয়স হবে ১৩। প্রতিটি আইকিউ পরীক্ষা যেমন বুদ্ধিমত্তার সামান্য ভিন্ন দিক পরিমাপ করে, তেমনি প্রতিটি স্কোরের পরিসরকেও অনেকভাবে শ্রেণিভুক্ত করে। সাধারণত মান ৭০-এর নিচে হলে জড়বুদ্ধিসম্পন্ন, ৭০-৯০-এর মধ্যে হলে স্বল্প বুদ্ধিসম্পন্ন, ৯০ থেকে ১২০-এর মধ্যে হলে স্বাভাবিক বুদ্ধিসম্পন্ন, ১২১ থেকে ১৪০-এর মধ্যে হলে অত্যন্ত বুদ্ধিসম্পন্ন এবং ১৪০-এর উপরে হলে তাকে একজন জিনিয়াস বলেই ধরা নেওয়া যাবে।

আইকিউ। প্রতীকী ছবি

আইকিউ পরীক্ষা কী পরিমাপ করে
জন ডেলুকা একজন নিউরোসাইকোলজিস্ট এবং কেসলার ফাউন্ডেশনের গবেষণার সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট, তিনি বলেছেন, ‘একটি আইকিউ পরীক্ষা আপনাকে বলবে যে আপনার সামগ্রিক বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতা কোন স্তরে আছে। এর মানে কি বোঝায় আপনার সব ধরনের জ্ঞান আছে? এরকমটি নয়। এর মানে আপনার কাছে উচ্চ স্তরে তথ্য প্রক্রিয়া করার ক্ষমতা রয়েছে। এর মানে এই নয় যে আপনি যা কিছু করেন তাতে আপনি দক্ষ। আইনস্টাইনের (সম্ভবত) উচ্চ আইকিউ ছিল, কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে তিনি তাঁর আর্থিক জীবন সম্পর্কে ভালো সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন।’

রেনি লেক্সো, মার্কিন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, তিনি এই বিষয়টির সাথে একমত যে, ‘স্মার্টনেস এবং একাডেমিক কৃতিত্ব বুদ্ধিমত্তার সমান নয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘স্মার্ট’ বিষয়ভিত্তিক হতে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, অনেক মা-বাবা সন্তানদের নিয়ে বলতে পারেন যে তাঁদের সন্তান স্মার্ট; কারণ, তাঁরা কিছু কাজ মুখস্থ করতে বা সম্পাদন করতে পারে ভালোভাবে। কিন্তু যখন বস্তুনিষ্ঠভাবে পরিমাপ করা হয়, তখন তাঁদের সন্তানেরা কেবল সাধারণ বুদ্ধিমত্তার হতে পারে।

লেক্সো আরও বলেন, তিনি বিশ্বাস করেন যে আইকিউ পরীক্ষা বিভিন্ন ধরনের সৃজনশীলতা এবং নমনীয়তা পরিমাপ করে; কারণ, পরীক্ষার সমস্যা সমাধানের জন্য ব্যক্তিকে ‘বাক্সের বাইরে চিন্তা’ করতে হয়। তবে পরীক্ষাগুলো একজনের সামাজিক সৃজনশীলতা পরিমাপ করে না বা মানসিক বুদ্ধিমত্তা।

কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের মানব বিকাশ এবং প্রায়োগিক মনোবিদ্যার অধ্যাপক স্ট্যানোভিচের মতে, আইকিউ পরীক্ষাকে এককভাবে গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই। তাঁর মতে, আইকিউ পরীক্ষাগুলো কিছু মানসিক অনুষঙ্গকে পরিমাপ করার ক্ষেত্রে খুব ভালো; যেমন যুক্তি, বিমূর্ত যুক্তি, শেখার ক্ষমতা এবং কর্ম-স্মৃতি ক্ষমতাসহ মস্তিষ্কের ধারণক্ষমতা ইত্যাদি।

আইকিউ। প্রতীকী ছবি

আইকিউ নিয়ে কিছু ভুল ধারণা
অনেকে ভেবে থাকেন যে বেশি আইকিউ হলে তার বুদ্ধিমত্তা এবং জীবনে সাফল্য হওয়ার সুযোগ বেশি থাকে। না, মোটেও এরকমটি নয়। কারণ, বুদ্ধিমত্তা পরীক্ষা দৈনন্দিন সিদ্ধান্ত গ্রহণের দক্ষতা পরিমাপ করে না। একজন ব্যক্তি অত্যন্ত বুদ্ধিমান হতে পারে এবং এরপরও ভুল বা বিপজ্জনক সিদ্ধান্ত নিতে পারে, যা সাফল্যকে বাধা দেয়। লেক্সো আরও বলেছেন, পুষ্টি, চিকিৎসা সমস্যা, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা এবং মেজাজ বা পরিবেশগত বিভ্রান্তি আইকিউ পরীক্ষায় কর্মক্ষমতা প্রভাবিত করতে পারে।

আইকিউ স্কোরও বয়স বিবেচনা করে। কারণ, সময়ের সাথে সাথে বুদ্ধিমত্তার কিছু দিক পরিবর্তন হওয়া স্বাভাবিক। উদাহরণস্বরূপ, ২০ বছর বয়সে আপনার প্রক্রিয়াকরণের গতি ৫০ বছর বয়সের তুলনায় দ্রুত হতে পারে, তাই স্কোরগুলো আপনার বয়সের জন্য গড় কী তা প্রতিফলিত করে। তাই ৩০ বছরের ব্যবধানে আপনি একই পরীক্ষা দিলেও আপনার আইকিউ স্কোর প্রায় একই থাকবে।

সুতরাং বলা বাহুল্য যে আইকিউ পরীক্ষা দিয়ে কোনও ব্যক্তির সঠিক বুদ্ধিমত্তার প্রকাশ পাওয়া যায় না। মানুষ কোনও যন্ত্র নয়। শুধু কিছু কাগজ কিংবা যন্ত্রের মাধ্যমে কিছু সংখ্যা দিয়ে মানুষকে বিচার করার অবকাশ নেই। যদিও এসব পরীক্ষা মানুষের বুদ্ধিমত্তার কিছুটা পূর্বাভাস দিতে পারে, কিন্তু বিজ্ঞানীদের মতে, এসব পরীক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের অবশ্যই মিতব্যয়ী এবং সতর্ক হতে হবে।

সর্বাধিক পঠিত