![](https://www.kishordigest.com/public/media/cache/image/1000x563x1/storage/news/2024/01/pKttHPlXAW2N8pS5yQMmZjlNuQmTouKHMJY98nvE.webp)
হিরণ পয়েন্ট থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা নাগাদ আমাদের জাহাজ দুবলার চরের অদূরে গিয়ে নোঙর ফেলে। ওই তো দূরে অন্ধকারে দুবলার চরের বাতিগুলো মিটমিট করে জ্বলছে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে ভেবে কেউ-কেউ না যাওয়ার ব্যাপারে মনস্থির করলেন। তবে আমার মতো উৎসুক অনেকেই ট্রলারে চেপে বসলেন। মিনিট দশেক পরে ট্রলার দুবলার চরে গিয়ে ভেড়ে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে ততটুকুই দেখা যায়, যতটুকু আলোর আয়ত্তে আছে। আমাদের জাহাজের সারেং ইমরান ভাই পথ দেখিয়ে আগে আগে যাচ্ছেন। আমরা তাকে অনুসরণ করে পিছুপিছু হাঁটছি। দেখে ভালো লাগছে, আধো আলো-অন্ধকারে শামসুন্নাহার ম্যাডাম দুলাভাইয়ের হাত ধরে হাঁটছেন। দুবলার চরে গিয়েও দুজনের হৃদ্যতার কমতি নেই। যেন বা নবপরিণীতা কোনও দম্পতি। এমন আরেক জুটি নূরুজ্জামান নয়ন দম্পতি। তারা বেশ স্বতঃস্ফূর্ত। আহমেদুল হক স্যার স্ত্রী-কন্যাদের সঙ্গে এনেছেন। বাবার প্রতি কন্যাদের যত্নশীল মনোভঙ্গি দেখে বলতেই হচ্ছে, আহমেদুল হক খান সত্যিই ভাগ্যবান। একটা ব্যাপার খেয়াল করেছি, ভ্রমণে এলে বয়সের ব্যবধান ঘুচে যায়। ৭০ বছরের প্রবীণ-প্রবীণার মাঝেও ভর করে শৈশব-কৈশোরের দুরন্তপনা। তারুণ্যের উদ্ভিন্ন প্রেমজোয়ার। সুন্দরবন ভ্রমণে এসে এমনই কিছু চিরতরুণ স্যার-ম্যাডামের দেখা পেয়েছি। তারা হলেন—শাহনাজ জাহান খান, তাহমিনা সুলতানা, তসলিমা আফরীন, নাসিমা সুলতানা, মনসুর রহমান খান, মিজানুর রহমান ও তরুণ কান্তি পাল।
![](https://www.kishordigest.com/public/media/cache/image/720x0x1/storage/news/2024/01/zYilAKQYgXgTwlr3fWm1bph8bLhYM9ze1jYLoIyT.jpg)
দুবলার চর রহস্যময় এক দ্বীপ। নারীবর্জিত জনবিচ্ছিন্ন জেলেদের গ্রাম। বিশেষ করে বছরের শীতমৌসুমে কেবল জেলেরা এখানে অবস্থান করে শুঁটকির জন্য মাছ সংগ্রহ করেন। নানা প্রজাতির মাছ ও কাঁকড়া শুঁটকির জন্যে দুবলার চর বিখ্যাত। মোট আয়তন ৮১ বর্গমাইল। চাঁদপাই রেঞ্জের গুরুত্বপূর্ণ এই চর কুঙ্গা ও মরা পশুর নদের মাঝামাঝি অবস্থিত। প্রতি বছর কার্তিক মাসে (খ্রিস্টীয় নভেম্বর) হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের রাসমেলা এবং পুণ্যস্নানের জন্যও দ্বীপটি বিখ্যাত। যদিও ধারণা করা হয়, ২০০ বছর ধরে এ রাসমেলা হয়ে চলেছে। তবে জানা যায়, ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে হরিচাঁদ ঠাকুরের এক বনবাসী ভক্ত, নাম হরিভজন (১৮২৯-১৯২৩), এই মেলা চালু করেন।
চারদিকে শুঁটকির তীব্র গন্ধ। প্রথমে কিছুটা অস্বস্তি বোধ করলেও কিছু সময় পর সয়ে যায়। দুবলার চরের বালিপথে আমরা হাঁটছি। ডানে-বামে নানাপ্রজাতির মাছের শুঁটকি, কিছু মাচানে, কিছু জালের ওপর বিছানো আছে। রোদে শুকিয়ে প্রস্তুত করে তারপর দেশে-বিদেশে রপ্তানি হবে। দুবলার চর থেকে সরকার নিয়মিত হারে রাজস্ব পেয়ে থাকে। আজম স্যার চট্টগ্রামের মানুষ। ফলে শুঁটকির ভালোমন্দ চেনেন ভালো। জেলেদের চালাঘর দেখলেই আমরা ভেতরে ঢুকে পড়ি। বড় বড় শুকনো শুঁটকির স্তূপ। মাটিতে চটের ওপর, বস্তায় কিংবা চৌকি সর্বত্র শুঁটকি মাছের মহোৎসব। আজম স্যার একের পর এক দরদাম করেই চলেছেন। শুঁটকি কোনটা শুকনো, কোনটা আধাশুকনো তিনি বুঝতে পারেন। শেষ পর্যন্ত লইট্টা শুঁটকি পছন্দ হলো। উপস্থিত সবাই ২/৩ কেজি করে কিনলেন। এ ছাড়া চিংড়ি, পোয়া, রূপচাঁদা, ছুরি ও চান্দা মাছের শুঁটকিও কেউ কেউ নিয়েছেন।
![](https://www.kishordigest.com/public/media/cache/image/720x0x1/storage/news/2024/01/lWB1CcvRlFDqXjSHHOU2nJ00ouvTnXgi8lAqW9d4.jpg)
দীর্ঘক্ষণ আধো আলো-অন্ধকার পথে হেঁটে হেঁটে পা ব্যথা হয়ে গেছে। রাত ৯টায় আমরা দুবলার চর ছেড়ে জাহাজে ফিরলাম। উপাধ্যক্ষ স্যারের আদেশ, রাতের আহার শেষে সবাই যেন জাহাজের ছাদে থাকি। কারণ, আজই র্যাফেল ড্র হবে। আগত অতিথিদের ভাগ্য পরীক্ষার পালা। হাঁসের মাংসের সঙ্গে পরোটা এবং কোরাল মাছের বারবিকিউ পার্টি। সব মিলিয়ে অসাধারণ অনাস্বাদিত স্বাদ। উপাধ্যক্ষ স্যার নিজ হাতে আমাদের খাবার পরিবেশন করেছেন। আমাদের সৌভাগ্য, একজন সুদক্ষ লিডার পেয়েছি। একটা ব্যাপার বলা হয়নি। উপাধ্যক্ষ স্যারের সহধর্মিণী এবং একমাত্র সুপুত্র প্রাঞ্জলও আমাদের ভ্রমণকে আনন্দময় করেছেন। ম্যাডাম অত্যন্ত মার্জিত ও মিষ্টভাষী। উপাধ্যক্ষ স্যারের মতো তিনিও আড়ালে-আবডালে আমাদের খোঁজ-খবর নিয়ে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। এই সুযোগে ম্যাডামকে ধন্যবাদ দিতে চাই।
র্যাফেল ড্র শুরু হয়েছে। উপাধ্যক্ষ স্যার রহস্যময় ভঙ্গিতে বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করছেন। সবচেয়ে ভাগ্যবান শামসুন্নাহার ম্যাডাম দম্পতি। তারা স্বামী-স্ত্রী উভয়েই পুরস্কার জিতেছেন। আকমল স্যার, রেজাউল স্যার, তাহমিনা খাতুন ম্যাডাম, তসলিমা আফরীন ম্যাডাম, শাহনাজ জাহান খান, আহমেদুল হক খান স্যারসহ আরও অনেকেই পুরস্কার পেয়েছেন। তবে আমাদের সঙ্গে থাকা ছোট্ট ছেলে-মেয়েদের সবার জন্যই পর্যাপ্ত শুভেচ্ছা উপহার বরাদ্দ ছিল। উপাধ্যক্ষ স্যার পর্যায়ক্রমে তাদের হাতে সেগুলো তুলে দিয়েছেন।
![](https://www.kishordigest.com/public/media/cache/image/720x0x1/storage/news/2024/01/CKEyoCL43vmjhotFYVwkhCn8F20MjKMlbakjGpHm.jpg)
এবার আমাদের বাড়ি ফেরার সময় হলো। সারা রাত বিরতিহীনভাবে জাহাজ চলেছে। তবে ট্যুর ম্যানেজার সোহরাব সাহেব জানালেন ফিরতি পথে ছেড়ে আসা করমজল দেখে তারপর যাবেন। সকাল ৯টায় আমরা করমজল স্পটে গিয়ে পৌঁছাই। করমজল পর্যটন কেন্দ্রটি পশুর নদের তীরে অবস্থিত। মংলা সমুদ্র বন্দর থেকে মাত্র আট কিলোমিটার দূরে ৩০ হেক্টর জমির উপর পর্যটন কেন্দ্রটি গড়ে তোলা হয়েছে। কেউ যদি একদিনে সুন্দরবন দেখে ফিরতে চান তবে এই করমজল স্পট বেছে নিতে পারেন। প্রকৃতির শোভা বাড়াতে এখানে রয়েছে কুমির, হরিণ, রেসাস বানরসহ নানা প্রজাতির পশুপাখি। এ ছাড়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য রয়েছে কাঠের ট্রেইল ও টাওয়ার। এমনকি বাংলাদেশের একমাত্র কুমিরের প্রাকৃতিক প্রজনন কেন্দ্রটি এখনে অবস্থিত। আমরা পর্যায়ক্রমে এসব দেখেছি। তবে কাঠের ট্রেইল থেকে নামার মুহূর্তে বানরের খপ্পরে পড়তে হয়েছে। এখানে মজার (কিন্তু বিপজ্জনকও হতে পারত) ঘটনা ঘটেছে। কাজী সাইফুল্লাহ স্যারের হাতে সেভেন আপের বোতল দেখে একটি বানর লাফিয়ে এসে তাকে পাকড়াও করল। হাতের বোতল এমন ভাবে চেপে ধরেছে যে, না নিয়ে যাবে না। একেবারে নাছোড়বান্দা। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে বোতলটি বানরকে দিয়ে দিতে হলো। মানুষের মতো দক্ষ হাতে বোতলের ছিপি খুলে শুঁকে দেখল। সেভেন আপের বদলে সাধারণ খাবার পানি দেখে বানরটি যারপরনাই হতাশ হলো। বোতলটি ফেরত দিয়ে পুনরায় লাফিয়ে চলে গেল। আরেকটি বানর শিফট ইনচার্জ তাহমিনা ম্যাডামের হাতের ব্যাগ নিয়ে টানাটানি শুরু করে। না জানি ব্যাগে মূল্যবান কোনও বস্তু রাখা আছে। বানরের এমন বুদ্ধিদীপ্ত চৌকস মনোভঙ্গি দেখে উপস্থিত সবাই বিস্মিত হয়েছি।
![](https://www.kishordigest.com/public/media/cache/image/720x0x1/storage/news/2024/01/Le9otccEtwdzbncGS5u8CkO1vbZLCeZGVdqNtN5I.jpg)
করমজল দেখাশেষে দুপুর ২টা নাগাদ আমাদের জাহাজ খুলনা বিআইডব্লিউটিএ-এর ৪নম্বর ঘাটে এসে ভিড়েছে। খুলনা রেলওয়ে স্টেশন থেকে ঢাকাগামী সুন্দরবন এক্সপ্রেস রাত ১০টায় ছেড়ে যাবে। বলা যায়, আমাদের সুন্দরবন দর্শনের ঘোরলাগা ভ্রমণের অবসান হয়েছে। তবুও অবসানেরও একটা রেশ থেকে যায়। প্রকৃতির গাঢ়তর সবুজ এখনও লেগে আছে চোখের ভাঁজে। অরণ্যের পরিশুদ্ধ অক্সিজেন, সমুদ্রের মৃদুমন্দ ঢেউ ভেতরলোক আন্দোলিত করবে বহু দিন। এই ছিল আমাদের মন কেমন করা সুন্দরবন ভ্রমণের বৃত্তান্ত। আমি আনন্দচিত্তে পঙক্তিতে-পঙক্তিতে অন্তিম অনুভূতি প্রকাশ করতে চাই—
অবশেষে সবই ঝরে যায়
সময়ের হলুদ হাওয়ায়
স্মৃতি তবু লিখে রাখে নাম
যেখানে আমিও ছিলাম।
আরও পড়ুন