০৬ জুলাই ২০২৫

ভিডিও গেম উদ্ভাবন ও জনপ্রিয়তার চমকপ্রদ গল্প

মিনহাজুল ইসলাম শান্ত
০২ জানুয়ারি ২০২৪, ১৯:০৫
ভিডিও গেমের ইতিহাস ও বিবর্তন। ছবি : কোলাজ

আধুনিক বিশ্বে ভিডিও গেম চেনে না, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। যদিও ভিডিও গেম নিয়ে রয়েছে নানা তর্ক-বিতর্ক, তবে এর জনপ্রিয়তা একটুও কমেনি, বরং দিন দিন বেড়েই চলেছে। প্রতিবছর মাল্টিবিলিয়ন ডলার খরচ করা হচ্ছে শুধু চিত্ত বিনোদনমূলক ভিডিও গেমের ওপর। 

ভিডিও গেমের ইতিহাস জানতে হলে আমাদের অবশ্যই কম্পিউটারের প্রথম দিনগুলো লক্ষ করতে হবে। ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে শুরু হয়েছিল ভিডিও গেমের যাত্রা, যখন কম্পিউটার বিজ্ঞানীরা মিনি কম্পিউটার এবং মেইনফ্রেম কম্পিউটারে সাধারণ গেম ও সিমুলেশন ডিজাইন করা শুরু করেছিলেন। ১৯৬২ সালে একটি বড় সাফল্য আসে, যখন এমআইটির ছাত্র স্টিভ রাসেল বন্ধুদের সাথে ‘স্পেসওয়ার’ গেম তৈরি করেন। গেমটিতে দুটি স্পেসশিপ ‘দ্য সুই’ ও ‘দ্য ওয়েজ’ নিয়ন্ত্রণযোগ্য বৈশিষ্ট্য করা হয়েছে, সেগুলো একটি নক্ষত্রের মাধ্যাকর্ষণ কূপে যুদ্ধে জড়িত থাকে। একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িত থাকার সময় মাঝে থাকা একটি জ্বলন্ত তারার মাধ্যাকর্ষণ এড়িয়ে চলতে হয়। উভয় স্পেসশিপ বা মহাকাশযান মানুষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। প্রতিটি মহাকাশযানে যুদ্ধ চালানোর জন্য সীমিত অস্ত্র ও জ্বালানি রয়েছে এবং খেলোয়াড় মহাকাশযানগুলোকে কোনও রকম ত্বরান্বিত না করলেও সেগুলো গতিশীল থাকে। স্পেসশিপ নির্গত মিসাইল তারা বা একে অপরের সাথে সংঘর্ষ হলে মহাকাশযানগুলো ধ্বংস হয়ে যায়।

স্পেসওয়ার ভিডিও গেমের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রভাবশালী গেমগুলোর মধ্যে একটি। ১৯৬০-এর দশকে এটি ছোট প্রোগ্রামিং সম্প্রদায়ের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল এবং সেই সময়ে অন্যান্য কম্পিউটার সিস্টেমে জনসাধারণের জন্যও ব্যাপকভাবে উন্মুক্ত করা হয়েছিল। ২০০৭ সালে স্পেসওয়ার ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দশটি ভিডিও গেমের তালিকায় জায়গা করে নেয়, যা লাইব্রেরি অব কংগ্রেসে গেম ক্যাননের সূচনা করেছিল। ২০১৮ সালে এটি ‘দ্য স্ট্রং’ ও ‘আইসিএইচইজি’ দ্বারা ওয়ার্ল্ড ভিডিও গেম হল অব ফেমে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।

স্পেসওয়ার গেম। ছবি : সংগৃহীত

১৯৭১ সালে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বাণিজ্যিক আর্কেড গেম উদ্ভাবিত হয়েছিল ‘কম্পিউটার স্পেস’। নোলান বুশনেল ও টেড ড্যাবনি ছিলেন এর পথপ্রদর্শক। স্পেসওয়ারের মূল ধারণাটি গ্রহণ করে একটি মুদ্রা-চালিত গেমিং মেশিন তৈরি এবং বিখ্যাত আমেরিকান ভিডিও গেম ইন্ডাস্ট্রির (আটারি) যাত্রা শুরু হয়। ১৯৭২ সালে প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত একটি টেবিল টেনিস গেম ‘পং’ তৈরি হয়। আমরা অনেকেই এই গেমটির সাথে পরিচিত, সে সময়ে পং বিশাল সাফল্য অর্জন করায় অন্যান্য মুদ্রা-চালিত আর্কেড নির্মাতারা বাজারে প্রবেশ করে এবং আর্কেড গেম শিল্প তৈরি করে।

এই আর্কেড গেমগুলো খেলতে হলে প্রয়োজন ছিল বিশাল রকমের যন্ত্র। তাই মানুষ ভাবতে থাকে কীভাবে সেগুলো তাদের টেলিভিশনে খেলা যায়। ১৯৭২ সালে রালফ এইচ বেয়ার, জার্মান ভিডিও-গেম উদ্ভাবক, একটি ম্যাগনাভক্স ওডিসি প্রকাশ করেন, যা ছিল বিশ্বের প্রথম বাণিজ্যিক কনসোল; যা টিভি গেমস নামে প্রচলিত ছিল। আটারি এই ধারণাটি মাথায় নিয়ে ‘পং’ এবং অন্যান্য ভিডিও গেমগুলো কনসোলের সাথে বাজারজাত করে সাফল্য অর্জন করে।

এরপর ভিডিও গেমকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নেওয়া হয়। ২১ এপ্রিল ১৯৮৯ সালে জাপানি কোম্পানি নিনটেন্ডো গেমবয় নামক প্রথম হাতে ধরে খেলা যায় এমন গেম কনসোল আবিষ্কার করে এবং ক্রেতাদের হৃদয় জয় করে নেয়। বিনিময়যোগ্য কিছু কার্ডের সাহায্যে গেমাররা তাদের ইচ্ছামতো গেম খেলতে পারে যখন-তখন যে কোনও জায়গায় এবং এটি শেষ পর্যন্ত গেমবয়ের সাফল্য নিয়ে আসে, যা সর্বকালের তৃতীয় সর্বাধিক বিক্রিত কনসোল হিসাবে খ্যাতি লাভ করে। ধীরে ধীরে এর জনপ্রিয়তা তরুণ এবং নতুন প্রজন্মের গেমারদের আকৃষ্ট করে। ১৯৯০ দশকের মধ্যে এবং তার পরেও গেমের সংস্কৃতি ব্যাপক বিস্তার লাভ করে। তখনকার সময়ে তৈরি কিছু আইকনিক গেম হচ্ছে মারিও, ক্র্যাশ ব্যান্ডিকুট, জেল্ডা, স্ট্রিট ফাইটার ইত্যাদি।

আর্কেড গেম। ছবি : সংগৃহীত

এরপর যখন ঘরে ঘরে কম্পিউটার আসা শুরু করল, তখন সবাই তাদের কম্পিউটারে গেম খেলতে শুরু করল। অবশ্য কম্পিউটারের ধারণক্ষমতা বেশি থাকায় আরও উন্নত মানের গেমও খেলা যেত। যেমন প্রথম জনপ্রিয় থ্রিডি গেম আসে কম্পিউটারের জন্যই; ১৯৯৩ সালে, যার নাম ছিল ‘ডুম’। ডুমকে এখন পর্যন্ত তৈরি করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফার্স্ট-পারসন শুটার হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

এভাবে প্রতি বছরই গেম এবং গেম কোম্পানিগুলো উন্নত হতে থাকে। ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা দিয়ে প্রতিবছরই বের হচ্ছে নতুন নতুন গেম। প্রথম জনপ্রিয় এবং সাশ্রয়ী গেম কোম্পানিগুলো; যেমন সেগা, আটারি, নিনটেন্ডোর মতো আরেকটি জাপানি কোম্পানি সনি প্রথমবারের মতো তাদের ফ্ল্যাগশিপ কনসোলগুলো চালু করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে সব গেম কোম্পানিগুলোকে ছাড়িয়ে সনি হয়ে ওঠে সবচেয়ে বড় গেম কনসোল প্রতিষ্ঠাতা কোম্পানি।

সনি প্লেস্টেশন ওয়ান ৯০-এর দশকজুড়ে ১০০ মিলিয়নের বেশি কপি বিক্রি হয়েছে। এই আধিপত্যের ফলে শেষ পর্যন্ত সেগা তার চূড়ান্ত কনসোল ‘ড্রিমকাস্ট’, যা ১৯৯৮ সালে বের করে গেমের দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়।

নিনটেন্ডো গেমবয়। ছবি : সংগৃহীত

তারই সাথে বিশাল হার্ডওয়্যার নির্মাতা মাইক্রোসফট কোম্পানিও ১৫ নভেম্বর ২০০১ সালে প্রথম তাদের গেম কনসোল (অরিজিনাল এক্সবক্স) বাজারে নিয়ে আসে। ইতিমধ্যেই বিখ্যাত এক্সবক্স ও প্লেস্টেশনের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয় যায়।

২০০৫ ও ২০০৬ সালে মাইক্রোসফটের এক্সবক্স-৩৬০, সনি প্লেস্টেশন-৩ এবং নিনটেন্ডো উইই হাই-ডেফিনিশন গেমিং জগৎ নিয়ে হাজির হয় পরবর্তী প্রজন্মের কাছে।

গেম খেলার আরেকটি যন্ত্র মোবাইল ফোন ২০০০ সালের পূর্বে তেমন জনপ্রিয় ছিল না, শুধু নোকিয়ার বাটন ফোনে জনপ্রিয় স্নেক গেম এবং জাভা প্রোগ্রামিং দিয়ে তৈরি কিছু জাভা গেম ছাড়া। ২০০৭ সালে আইফোন প্রকাশ হয়, এটি সবকিছু বদলিয়ে দিয়েছিল। আইফোনের অ্যাপ স্টোর চালু হওয়ার পরে অ্যাপ্লিকেশন উপলব্ধ ছিল এবং বেশ কিছু গেমও ছিল। সেখান থেকে স্মার্টফোনেও ভিডিও গেমের প্রচলন বাড়তে থাকে এবং আজকের দিনে তাকালে আমরা বুঝতে পারি, মোবাইল গেমও কোন কোন পর্যায়ে রয়েছে।

সনি প্লেস্টেশন। ছবি : সংগৃহীত

এভাবে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে প্রতিটা গেম এবং এগুলোর কোম্পানিগুলো আরও নতুনত্ব এনেছে। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় আরও উন্নত হচ্ছে সেগুলো। বর্তমানে গেম যেন একটি নতুন অর্থ উপার্জনের পন্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিভিন্ন গেম টুর্নামেন্টের মাধ্যমে বিপুল অর্থ উপার্জন করছে তরুণেরা। বিভিন্ন স্ট্রিমিং করেও আয় করছে অনেকে। এ যেন মানুষকে এক কল্পনার জগতে নিয়ে এসেছে, যা একসময় মানুষের ভাবনা-চিন্তার বাইরে ছিল। তবে তরুণদের ভিডিও গেমে আসক্ত হয়ে পড়া নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়াচ্ছে অনেককে।

সর্বাধিক পঠিত