
বিশ্বে প্রতিনিয়তই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জনসংখ্যা। একইসাথে শিক্ষা, ব্যবসা, শিল্প, সেবা ও চিকিৎসা সব ক্ষেত্রেই চলছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তির মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়করণ। মানুষের শ্রমের বিপরীতে ধীরে ধীরে বাড়ছে যন্ত্রের ব্যবহার। আর এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ছে সব ইন্ডাস্ট্রিতেই। বাদ পড়েনি গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতাও।
২০২৩ সালে আলোচিত ঘটনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল দেশের মূলধারার টেলিভিশন চ্যানেল থেকে শুরু করে বেশ কয়েকটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সংবাদ পাঠকের ব্যবহার। এর সূচনা হয়েছিল চীনের সিনহুয়া নিউজ এজেন্সিতে। কম্পিউটার গ্রাফিক্সের মাধ্যমে তারাই বিশ্বের প্রথম এআই-চালিত নিউজ অ্যাঙ্কর নিয়ে এসে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। কেবল সংবাদ পাঠই নয়, সংবাদ লেখা, সংবাদ পার্সোনালাইজেশন, ট্রান্সক্রাইব ও অডিও-ভিডিও কনটেন্ট তৈরিসহ নানা কাজে এআই প্রযুক্তি এখন পারদর্শী।
শিকাগোভিত্তিক টেক কোম্পানি ন্যারেটিভ সায়েন্সের ভাষ্যমতে, ২০২৫ সালের মধ্যে একটি এআই বটই ৯০ শতাংশ খবর লিখে দিতে সক্ষম হবে। তাদেরই সফটওয়্যার কুইল (Quill) যে কোনও বিস্তৃত তথ্যকে সহজপাঠ্য প্রতিবেদনে পরিণত করতে বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে বিশ্বের স্বনামধন্য অনেক মিডিয়া হাউজই সংবাদ প্রতিবেদন তৈরির প্রক্রিয়ায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্য নিচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে ওয়াশিংটন পোস্ট, অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস, বিবিসি, রয়টার্স, ব্লুমবার্গ, নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, টাইমস এবং সানডে টাইমস, জাপানের ন্যাশনাল পাবলিক ব্রডকাস্টার, এনএইচকে এবং ফিনল্যান্ডের এসটিটি।
এআই প্রযুক্তি পৌঁছে গেছে নিউজরুমেও। ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং প্রোগ্রামগুলো অবিকল মানুষের মতো সাড়া দিতে সক্ষম হওয়ায় সাংবাদিকেরা এগুলো ব্যবহার করে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বিস্তৃত তথ্য থেকে সহজপাঠ্য প্রতিবেদন লেখা, তথ্য যাচাই করার কাজ করতে পারছেন। যেমন অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) Automated Insights নামের এআই সিস্টেম ব্যবহার করে, যা দিয়ে দৈনন্দিন পুনরাবৃত্তিমূলক সংবাদ নিবন্ধ, বিশেষ করে খেলাধুলা এবং ব্যবসা-সংক্রান্ত খবর লেখা যায়। রয়টার্স ‘Reuters News Tracer’ নামে এআই সিস্টেম ব্যবহার করে, যা রয়টার্সের সাংবাদিকদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খবর খুঁজে পেতে এবং তথ্য যাচাই-বাছাই করতে সাহায্য করে। তেমনি ফোর্বস ছোট নিবন্ধ বা সারাংশ লেখার জন্য ব্যবহার করে ‘Bertie’ নামের একটি এআই সিস্টেম। আর সবশেষে ওপেন এআইয়ের ‘ChatGPT’ তো সবার ঘরে ঘরে আছেই। কারণ, একে যে কোনও বিষয় দিলে নিমিষেই একটা বড় প্রতিবেদন লিখে দিচ্ছে। যা একজন মানুষের পক্ষে লিখতে গেলে বেশ সময়ের প্রয়োজন। এখন বন্ধু হিসেবে এআই সাংবাদিকতায় কীভাবে সাহায্য করে তার কিছু নমুনা দেখে আসা যাক।

অটোমেটেড রেগুলেশন
এই সিস্টেমের মাধ্যমে মিডিয়া হাউজগুলো তাদের সাইটে সংবাদ বা অন্যান্য নিবন্ধে পাঠক মন্তব্য রেগুলেট করতে পারে, নিউরাল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে অটোমেটিক ফটো-ট্যাগিং, ভিডিও এডিটিং, ভয়েস প্যাকেজিং, ডেটা মাইনিং ইত্যাদিসহ নানা ধরনের কাজ সম্পাদন করতে সক্ষম হয়।
নিউজ পার্সোনালাইজেশন
পাঠকদের আগ্রহ এবং পছন্দকে ট্রেস করতে এআই অ্যালগরিদমগুলো বেশ পারদর্শী। আর সেই অনুসারে সংবাদকে অডিয়েন্সের কাছে পৌঁছে দিতে পারে। খেয়াল করলে দেখবেন, আপনি ফেসবুক স্ক্রল করার সময় যে নিউজটায় ক্লিক করবেন, পরবর্তীতে সেই বিষয়ক নিউজগুলোই আপনার সামনে আসতে শুরু করবে। The Times-এর JAMES নামের এআই প্রোগ্রাম পাঠকের অভ্যাস, আগ্রহ এবং পছন্দ ট্রেস করে তার কাছে সেই ধরনের সংবাদের নোটিফিকেশন পৌঁছে দেয়।
ফ্যাক্ট-চেকিং
কিছু কিছু নিউজ আউটলেট রিপোর্টিংয়ের তথ্য যাচাই করতে স্বয়ংক্রিয় ফ্যাক্ট-চেকিং টুলের সাহায্য নেয়। মূলত এই টুলগুলো Natural Language Processing (NLP) এবং মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদম ব্যবহার করে তথ্যের সঠিকতা যাচাই করে। যেমন অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস খবরের সত্যতা যাচাই করতে সাহায্য করার জন্য ‘Verify’ নামের একটি টুল ব্যবহার করে। রয়টার্সও ব্যবহার করে নিজেদের ডেভেলপ করা ‘Reuters Fact Check’ এবং ওয়াশিংটন পোস্ট ব্যবহার করে ‘Heliograf’। আবার ফ্যাক্টমাটা নামের একটি কোম্পানি আছে যারা টাইমস অব লন্ডন, দ্য গার্ডিয়ান এবং নিউইয়র্ক টাইমস-এর মতো সংবাদ হাউজগুলোতে ফ্যাক্ট চেকিং সুবিধা সরবরাহ করে। বর্তমান সময়ে যে কোনও তথ্য প্রকাশের আগে ফ্যাক্ট চেক করে নেওয়া অতীব জরুরি।

অ্যাকটিভ অডিয়েন্স বৃদ্ধি করা
এআই ব্যবহার করে সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের গ্রাহকদের পছন্দ-অপছন্দ বুঝতে পারছে অনায়াসেই। সে অনুযায়ী সংবাদমাধ্যমগুলো আরও প্রাসঙ্গিক এবং আকর্ষণীয় করে সেখানে অডিয়েন্সকে বেশি সময় ধরে এনগেজ করার সুযোগ পাচ্ছে। এতে আমাদের দেশের সংবাদমাধ্যমগুলোও পিছিয়ে নেই। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে বাজারে টিকে থাকতে তারা নিচ্ছে ‘ডিজিটাল ফার্স্ট’ হাউজ পলিসি, ঢেলে সাজাচ্ছে নিজেদের বিজনেস মডেল। আগের সেট-আপ ভেঙে দিয়ে নিউজরুমে ডিজিটাল সেকশনের জন্য ছেড়ে দিচ্ছে অতিরিক্ত জায়গা। চাহিদা বাড়ছে ডিজিটাল মাধ্যমে জ্ঞান ও দক্ষতাসম্পন্ন জনবলের। এমনকি পরিবর্তন এসেছে সংবাদ সোর্সিং, সংবাদ লেখা, উপস্থাপনা, বন্টন, বিজ্ঞাপনী সংস্থাসহ নানান দিকেও।
এ থেকে বোঝা যায় আগামীতে এআই প্রযুক্তি আরও বহুমুখী কাজে ব্যবহৃত হবে। তবে এটা একদিকে সাংবাদিকতাকে যেমন গতিশীল করছে, তেমনি অন্যদিকে জন্ম দিচ্ছে কিছু চ্যালেঞ্জের। কারণ, একজন মানুষ যেভাবে সংবাদের স্থান-কাল বিবেচনা করে একটি প্রতিবেদন তৈরি বা বিশ্লেষণ করতে পারবে তা এআই কখনোই পারবে না। ফলে সেদিক থেকে বিবেচনা করলে সাংবাদিকদের প্রয়োজন কখনোই ফুরিয়ে যাবে না। তাই এআই আসায় চাকরি হারাবার ভয় আপাতত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারেন। কিন্তু পুনরাবৃত্তিমূলক প্রতিবেদন লেখার কাজগুলোর জন্য আলাদা লোকবলের প্রয়োজন হয়তো ফুরিয়ে যাবে। কারণ, এটা সত্যি যে এআই মানুষের চেয়ে হাজার গুণ কম সময়ে, বিস্তৃত তথ্যভাণ্ডার থেকে মুহূর্তেই সারাংশ বের করে দিয়ে সংবাদ লিখে দিচ্ছে। পুরো বিষয়টি মানুষের সৃজনশীলতার জন্য যেমন হুমকি হয়ে দাঁড়ায়, তেমনি আবার কনটেন্টের অথরশিপ কীভাবে নির্ধারিত হবে, তা নিয়েও জটিলতা সৃষ্টি করে। এ ছাড়া সাংবাদিকতার অবজেক্টিভিটি বা ক্রেডিবিলিটির জায়গাটিও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।

চলমান বিশ্বে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির উন্নয়ন ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। তবে এর সাথে জড়িত চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে আগে থেকেই কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। তার জন্য সাংবাদিকতার পাঠ্যসূচিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিষয়গুলো যুক্ত করতে হবে যেন শিক্ষার্থীরা এআই পরিচালিত সিস্টেম, তথ্যপ্রযুক্তি-সম্পর্কিত টুলস ব্যবহারে দক্ষ হয়ে ওঠে। ডিজিটাল লিটারেসি, ডেটা অ্যানালাইসিস, ডেটা ভিজুয়ালাইজেশন, মাল্টিমিডিয়া স্টোরিটেলিং, ফ্যাক্ট-চেকিং, সাইবার সিকিউরিটি, সোশাল মিডিয়া প্রমোশন, মনিটাইজিং ও ডিজিটাল মার্কেটিং ইত্যাদির ধারণাগুলো কারিকুলামে যোগ করতে হবে। এ ছাড়া সংবাদ হাউজগুলোয় যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাংবাদিকদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলেই তারা প্রযুক্তির জ্ঞান নিয়ে জনবল থেকে আগামী বিশ্বের জনসম্পদে পরিণত হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে যেন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের জায়গা দখল না করে বরং মানুষের কাজে সহায়ক হিসেবেই সীমাবদ্ধ থাকে।