১৩ জুন ২০২৫

মুঠোফোন আবিষ্কারের চমকপ্রদ গল্প

মিনহাজুল ইসলাম শান্ত
২৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:৪৯
মার্টিন কুপারকে সেলুলার ফোনের জনক বলা হয়। ছবি : এএফপি

প্রযুক্তির এক বিশাল এবং প্রজন্ম বদলে দেওয়া আবিষ্কার হচ্ছে মোবাইল ফোন। এটি মানুষের জীবনযাত্রার মানকেই ঘুরিয়ে দিয়েছে ১৯৭৩ সাল থেকে । বর্তমান বিশ্বে ৭.৩৩ বিলিয়ন, প্রায় ৯০.৯৩ শতাংশের বেশি মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করে থাকেন। কীভাবে বদলে দিতে পারে শুধু একটি হাতমুঠো যন্ত্র? কোথা থেকে এবং কীভাবে শুরু হয়েছিল এর যাত্রা?

মার্টিন কুপার একজন মার্কিন ইঞ্জিনিয়ার, যিনি ১৯৭৩ সালে প্রথম মোবাইল ফোন তৈরি করেন। তাঁকে সেলুলার ফোনের জনক বলা হয়ে থাকে।

মার্টিন কুপার কাজ করতেন তখনকার একটি ছোট টেলিকম কোম্পানি মটোরোলায়। ১৯৫৪ সালে তিনি মটোরোলায় কাজ শুরু করেন। মটোরোলায় কুপার ওয়্যারলেস যোগাযোগের সাথে জড়িত অনেক প্রকল্পে কাজ করেছেন। যেমন প্রথম রেডিও-নিয়ন্ত্রিত ট্রাফিক-লাইট সিস্টেম। এজন্য তিনি ১৯৬০ সালে সরকারি সনদপত্রও পেয়েছিলেন এবং প্রথম হ্যান্ডহেল্ড পুলিশ রেডিও, যা ১৯৬৭ সালে চালু হয়েছিল। তাঁর স্বপ্ন ছিল এমন একদিন আসবে, যখন সবার হাতেই নিজস্ব ফোন থাকবে, আর সেই ফোনে যে কোনও সময় যোগাযোগ করা যাবে।

বিবিসির লুইস হিদালগোকে মার্টিন কুপার বলছিলেন, সাধারণ মানুষের কাছে এ গল্প বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির মতো শোনাবে, ‘কারণ, এর আগের একশ বছর ধরে টেলিফোন মানেই ছিল এমন একটা জিনিস, যা আমাদের কাজের টেবিল বা বাড়িতে একটা তারের সাথে যুক্ত। বলতে পারেন এটা একটা কুকুরের গলার শেকলের মতোই। কিন্তু আমাদের মনে হয়েছিল, মানুষ আসলে মৌলিকভাবেই গমনশীল এবং সে যেখানেই থাকুক না কেন, সব সময়ই অন্যদের সাথে যুক্ত থাকবে। কাজেই আমাদের সেই যন্ত্র তৈরি করতে হবে, যা আগে কখনও তৈরি হয়নি এবং ঠিক সেই জিনিসটাই আমরা বানিয়ে ফেললাম—মাত্র তিন মাসের মধ্যে।’

মূলত আমেরিকান কমিক স্ট্রিপ ডিক ট্রেসি চরিত্রেরা পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগের জন্য হাতঘড়ির মতো যে টু ওয়ে রিস্ট রেডিও ব্যবহার করত, সেটা দেখেই আসলে মার্টিন কুপারের মাথায় প্রথম মোবাইল ফোনের চিন্তাটি এসেছিল।

১৯৭৩ সালের এপ্রিল মাসে নিউইয়র্কের হিলটন হোটেলে মার্টিন কুপার এবং তাঁর দল প্রথম হাতে-ধরা ফোন (মটোরোলা ডায়না টিএসি ৮০০০এক্স) প্রোটোটাইপটি প্রদর্শন করেছিলেন। সেই প্রথম মোবাইল ফোনটি ছিল ১০ ইঞ্চি লম্বা, দুই ইঞ্চি চওড়া এবং ৪ ইঞ্চি উঁচু। তখন মোবাইল ফোনটির ওজন ছিল এক কিলোগ্রামের বেশি।

৫০ বছর আগে মোবাইল ফোনের জনক মার্টিন কুপার ১৯৭৩ সালের ৩ এপ্রিল নিউইয়র্কের সিক্সথ এভিনিউয়ের এক কোণে দাঁড়িয়ে রেডিও চ্যানেলের একজন সাংবাদিকের সামনে তাঁর পরিচিত প্রকৌশলী জোয়েল ইঙ্গলকে প্রথম মোবাইল ফোনে কল করেন। আর এটিই ছিল মোবাইল ফোনে প্রথম কথোপকথন।

মার্টিন কুপার জোয়েল ইঙ্গলকে সংবর্ধনা জানিয়ে বলেন, ‘হাই জোয়েল, আমি মার্টিন কুপার বলছি। আমি তোমাকে ফোন করেছি একটা সেলফোন থেকে। একটা সত্যিকারের সেলফোন, একটি হাতে ধরা, ব্যক্তিগত ফোন; যা সাথে নিয়ে চলাফেরা করা যায়।’ তা শুনে জোয়েল ইঙ্গল খুবই অবাক হন এবং চুপ হয়ে যান। কারণ, সে সময় পর্যন্ত হাতে ধরা সেলফোন আবিষ্কার হয়নি। জোয়েল ইঙ্গল তখন আমেরিকার এটিএন্ডটি কোম্পানির একজন ইঞ্জিনিয়ার। এটিএন্ডটি তখন সারা বিশ্বের সবচেয়ে বড় টেলিকম কোম্পানি। আসলে এটিএন্ডটিও তখন ভবিষ্যতের ফোন নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে। সেলুলার টেকনোলজি নামে এক নতুন প্রযুক্তির সূচনা করেছিল তারাই। ১৯৪৬ সালে এটিএন্ডটি প্রথম মোবাইল টেলিফোন আবিষ্কার করলেও ছিল অনেক দুর্বলতা, খুব অল্প সংখ্যক এলাকায় ব্যবহারের উপযোগী ছিল এবং এগুলো চালানোর জন্য যে বিপুল পরিমাণ শক্তি প্রয়োজন, তা শুধু গাড়ির ব্যাটারি দিয়েই সরবরাহ করা যেত। এভাবে সত্যিকারের কোনও পোর্টেবল ফোন ছিল না, কিন্তু শুধু গাড়ি ফোন ছিল। তারা ভেবেছিল গাড়ির সাথে সংযুক্তিই ফোনের ভবিষ্যৎ। হাতে করে ফোন নিয়ে ঘোরার কথা তারা ভাবেনি।

কিন্তু ছোট কোম্পানি মটোরোলা এটিএন্ডটির সেই ভাবনাকে ভুল প্রমাণিত করল। সেলফোনটি বাণিজ্যিকভাবে বিশ্বের কাছে পৌঁছানো ছিল আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, আমেরিকার বেতার তরঙ্গ নিয়ন্ত্রণ করত যে ফেডারেল টেলিকমিউনিকেশন কমিশন, তাদের কাছে এটিএন্ডটি দেনদরবার করছে যেন তাদের রেডিও স্পেকট্রাম ব্যবহারের একচেটিয়া অনুমতি দেওয়া হয়। কারণ, এর ফলে তারা আমেরিকার যে লাখ লাখ গাড়ি সেলুলার প্রযুক্তি ব্যবহার করে, তাতে টেলিফোন সংযোগ দিতে পারবে।

মটোরোলা জানত, যদি এটিএন্ডটি একবার এই একচেটিয়া কর্তৃত্ব পেয়ে যায়, তাহলে তারা তাদের সেলফোনের জন্য সেই নেটওয়ার্ক আর ব্যবহার করতে পারবে না। কাজেই মটোরোলাকে একটি বড় কিছু করে কমিউনিকেশন কমিশনারদের প্রভাবিত করতে হবে এবং একটি মোবাইল ফোন তৈরি করে দেখাতে হবে। এটি ছিল মটোরোলার কাছে একটি কঠিন যুদ্ধের মতো। মার্টিন এবং তাঁর দলকে মাত্র তিন মাসের মধ্যে মোবাইল ফোন আবিষ্কার করতে হয়েছিল। মটোরোলাকে এজন্য অনেক অর্থ বিনিয়োগ করতে হয়েছিল। অবশেষে দীর্ঘ পরিশ্রমের পর তারা ১৯৭৩ সালে দুটো প্রোটোটাইপ বানিয়েছিল। কিন্তু তখন সেটি বাজারজাত করতে পারেনি মটোরোলা। কারণ, তাদের আমেরিকান ফেডারেল নিয়ন্ত্রকদের কাছ থেকে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সির গ্যারান্টি পেতে আরও কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। এতে ভূমিকা রেখেছিলেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানও।

শেষ পর্যন্ত ১৯৮৩ সালে প্রথমবারের মতো বাজারে এলো মটোরোলার প্রথম সেলুলার ফোন (মটোরোলা ডায়না টিএসি ৮০০০এক্স)। তখনকার সময় ৩,৯৯৫ মার্কিন ডলারে ফোনটি বিক্রি হলেও সেটি সফল ছিল।

এভাবেই শুরু হয়েছিল প্রথম হাতে ধরা সেলফোনের যাত্রা। পর্যায়ক্রমে এর উন্নতি হতে থাকে এবং আজ বিশ্বের কাছে এটি নতুন একটি রূপ নিয়ে হাজির হয়েছে। বর্তমানে এই মুঠোফোন ছাড়া এক মুহূর্তও কল্পনা করা যায় না।

সর্বাধিক পঠিত