
নিজের দ্বিতীয় ওভার শেষে রোহিত পাউডেলের সাথে একটু কথা কাটাকাটি হলো তানজিম হাসান সাকিবের। দুজন এগিয়ে গেলেন একে অপরের দিকে। তানজিম সাকিবের রক্তচক্ষু। আক্রমণাত্মক ভঙ্গি। কী যেন বললেন, নেপালের অধিনায়ক তাঁকে দেখিয়ে দিলেন বোলিং প্রান্ত! জবাবের জন্য তানজিম জমা রাখলেন পরের ওভারটা। প্রথম বলেই ফিরিয়ে দিলেন রোহিতকে। জবাবটাও দেওয়া হয়ে গেল তাঁর। তিনি মাঠের জবাবটা মাঠেই দিতে জানেন। বাংলাদেশের ব্যাটিং অর্ডার যখন বিপুল বিক্রমে ব্যর্থতার মিছিলেন সামিলে হয়েছেন– তখন জয়ের প্রদীপ জ্বালিয়েছেন অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ জয়ী এই ক্রিকেটার।
নেপালের বিরুদ্ধে নিজের দ্বিতীয় ওভারেই তানজিম ৩ বলের মধ্যে ২ উইকেট শিকার করেন। সেটি আবার করেন মেডেন। নিজের পরের ওভারেও কোনো রান না দিয়ে তানজিম নেন আরেকটি উইকেট। চতুর্থ ওভারে শিকার করেন আরেকটি উইকেট। টানা ৪ ওভারে মাত্র ৭ রান দিয়ে ৪ উইকেট নেন এ পেসার, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে যেটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় সেরা বোলিং ফিগার।
নেপালের বিরুদ্ধে চার ওভারের এক স্পেলে যা যা করা সম্ভব তার সবই করেছেন তানজিম। রান গুণেছেন মাত্র সাতটি। ডট দিয়েছেন ২১ টা। স্কোরিং ডেলিভারি মোটে তিনটা, সাথে একটা ওয়াইড। এ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের অন্যতম সেরা আবিস্কার বলা যায় এই তানজিমকে। গ্রুপ পর্বে গোটা আসর জুড়েই তিনি নতুন বলে রীতিমত আগুন ঝরিয়েছেন। আগ্রাসী বোলিংয়ে উইকেট শিকার করেছেন।

দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষেও নেন তিনটি উইকেট। এমন কোনো ম্যাচ নেই যেখানে তিনি ছিলেন উইকেটশূন্য। চার ম্যাচে উইকেট পেয়েছেন নয়টি। নতুন বলে এমন পারফরম্যান্স টুর্নামেন্টেরই অন্যতম সেরা। অথচ, তাঁকে বিশ্বকাপ দলে নেওয়া নিয়েও কম সমালোচনা হয়নি। সমর্থক মহল তো বটেই, পারফরম্যান্সের বিচারেও অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে ছিলেন মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন। তবে, প্রধান নির্বাচক গাজী আশরাফ হোসেন লিপু বারবারই তানজিম হাসান সাকিবের আগ্রাসন আর দলের প্রতি নিবেদনের কথা বলেছেন। এবার সেই আগ্রাসনটাই কাজে লাগল বিশ্বকাপে। ধ্বংস্তুপ থেকে মাথা তুলে দাঁড়ালেন আগ্রাসী এক তানজিম সাকিব!
নেপালের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ জয়ী হয়েছে, বিশ্বকাপের সুপার এইটে উঠেছে। এ ম্যাচে দারুণ বোলিংয়ের জন্য ম্যাচ সেরার পুরস্কার পেয়েছেন তানজিম হাসান সাকিব।
হালকা-পাতলা শরীর তানজিম সাকিবের। তেমন দীর্ঘদেহীও নন, উচ্চতা ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি। দেখে মনেই হবে না তিনি জাতীয় দলের ক্রিকেটার, তা-ও আবার পেসার! তাসকিন আহমেদ, শরীফুল ইসলাম, ইবাদত হোসেনের মতো দীর্ঘদেহী পেসারদের ভিড়ে তাঁকে খুঁজে পাওয়াই কঠিন। দীর্ঘদেহী পেসারদের সারিতে তিনি যেন এক ব্যতিক্রম। তিনি ব্যতিক্রম তাঁর আগ্রামী মনোভাবের জন্য, প্রতিনিয়ত লড়াই করার মানসিকতার জন্য। এ মানসিকতাই তাঁকে অন্যদের চেয়ে ব্যতিক্রম করেছে, চিনিয়েছে তাঁর নিজস্বতা।
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে এশিয়া কাপে ভারতের বিপক্ষে অভিষেক হয় তানজিমের। ভারতের বিপক্ষে অভিষেক ম্যাচে নিয়েছিলেন ২ উইকেট। ইনিংসের দ্বিতীয় বলেই ভারতের অধিনায়ক রোহিত শর্মাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন শূন্য রানে। পরে তিলক বর্মাকেও করেন বোল্ড। ম্যাচটাও জিতেছিল বাংলাদেশ। ভারতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে একটা ম্যাচই খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন তানজিম এবং সেটা শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। ১০ ওভারে রান (৮০) একটু বেশি দিয়ে ফেললেও সেই ম্যাচেও ৩ উইকেট ছিল তাঁর। বাংলাদেশ জিতেছিল সেই ম্যাচও। এই একটা ব্যাপার যেন নিয়মই হয়ে গেছে। তানজিম যে ম্যাচে ভালো বোলিং করবেন বা উইকেট পাবেন, সেই ম্যাচ বাংলাদেশই জিতবে।
তানজিম আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি খেলছেন ডিসেম্বর থেকে। ছোট্ট ক্যারিয়ার, কিন্তু এর মধ্যেই দুটি বিশ্বকাপ খেলে ফেলছেন। একটি ভারতে অনুষ্ঠিত গত ওয়ানডে বিশ্বকাপ, এরপর এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। দীর্ঘদেহী নন, ধারাবাহিকভাবে ঘণ্টায় ১৪০ কিলোমিটারের আশপাশের গতিতে বল করেন না। বিশ্বকাপ দলে জায়গা হয়নি দক্ষতায়ও তাঁর চেয়ে এগিয়ে থাকা কয়েকজন পেসারের। তাহলে তানজিম কীভাবে এত দ্রুত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ পেস আক্রমণে জায়গা করে নিলেন? উত্তর একটাই—আত্মবিশ্বাস। নিজেকে কীভাবে গড়ে তুলেছেন, সে প্রসঙ্গে একবার তিনি বলেছিলেন, ‘ক্রিকেট অনেকটাই স্নায়ুর খেলা। যত আত্মবিশ্বাসী থাকবেন, তত প্রতিপক্ষকে দমিয়ে রাখতে পারবেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আসার আগে আমার এটাই চিন্তা ছিল। আমি বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে এভাবেই খেলেছি, ঘরোয়া ক্রিকেটেও এভাবে খেলেই নিজেকে তৈরি করেছি।’
তানজিমের এই মানসিকতা চোখে পড়েছে টিম ম্যানেজমেন্টেরও। বিশ্বকাপের জন্য দেশ ছাড়ার আগে ঘরের মাঠে জিম্বাবুয়ে সিরিজে ২ ম্যাচ খেলে মাত্র ১ উইকেট নিয়েছিলেন তানজিম। ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন ৪ ম্যাচে নেন সিরিজ সর্বোচ্চ ৮ উইকেট। তবু আক্রমণাত্মক মানসিকতার কারণেই বড় মঞ্চের জন্য সাইফউদ্দিনের চেয়ে তানজিমকে যোগ্য ভেবেছেন নির্বাচকেরা। তিনি সেই আস্থার প্রতিদানও দিয়েছেন তানজিম। গ্রুপ পর্বের ৪ ম্যাচে শিকার করেছেন ৯ উইকেট।
তানজিম সাকিবের সাফল্যের পেছনে মূল নিয়ামক তাঁর আত্মবিশ্বাস ও পরিশ্রম। প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী, যার ফলে তাঁর মধ্যে দেখা যায় আগ্রাসন, দেখা যায় আক্রমণাত্মক মনোভাব। আত্মবিশ্বাসের জোরেই তিনি ঘায়েল করতে জানেন বাঘা ব্যাটসম্যানদের। এ ছাড়াও প্রচণ্ড পরিশ্রমী তানজিম। প্রতিনিয়ত নিজেকে নিয়ে কাজ করেন, ফিটনেস ঠিক রাখেন। বোলিংয়ে নতুন কিছু করার চেষ্টা করেন। বলের ওপর নিয়ন্ত্রণও তাঁর চমৎকার। ভবিষ্যৎতে তিনি যদি বল দুই দিকেই সুইং করাতে পারেন, মোটামুটি গতি ঠিক রাখতে পারেন, তাহলেই তিনি হয়ে উঠতে পারবেন বিশ্ব সেরা বোলার। আত্মবিশ্বাসী ও পরিশ্রমী তানজিম তা পারবেন, এটা আশা করা যেতেই পারে।