
অনেকদিন ধরেই দ্রুত গতির বোলারের জন্য আক্ষেপ বাংলাদেশের। এ আক্ষেপ মেটাতেই যেন নাহিদ রানার আগমন। বয়স তাঁর মাত্র ২১ বছর। তরুণ রানার উত্থান বিস্ময়করই। ১৮ বছর বয়সে একাডেমিতে ভর্তি হওয়া তরুণ পেসার প্রথমবারের মতো ক্রিকেট বল হাতেই নিয়েছেন ২০২১ সালে। তারপর অল্প সময়েই এনসিএল, বিপিএল হয়ে এখন তিনি জাতীয় দলের আঙিনায়। অভিষেকেই গতির ঝড় তুলেছেন, চমক জাগিয়েছেন, দরকারের সময় উইকেট শিকার করেছেন তিনটি। দ্রুত গতির পেস বোলারের জন্য বাংলাদেশের আক্ষেপ তিনি যেমন মেটাতে পারেন, তেমনই হয়ে উঠতে পারেন আক্ষেপের উদাহরণও। জাতীয় দলে যত দ্রুত এসেছেন, তত দ্রুত হারিয়ে যাবেন না তো?
পাড়ার ক্রিকেটে টেপ টেনিসে খেলা নাহিদ ক্রিকেট দিক্ষা নেওয়া শুরু করেন একটু বেশি বয়সে। ১৮ বছর বয়সে রাজশাহীতে ক্লেমন ক্রিকেট একাডেমিতে ভর্তি হন তিনি। এখন তাঁর বয়স ২১, মাত্র তিন বছরেই ডানহাতি পেসার নিজেকে নিয়ে গেছেন পরের ধাপে। জাতীয় দল নামের ঠিকানায় পা রাখতে প্রক্রিয়ায় থাকতে হয়, পাড়ি দিতে হয় কয়েকটা ধাপ। বয়সভিত্তিক পেরিয়ে পারফরম্যান্স ইউনিট (এইচপি) বা ‘এ’ দল হয়ে আসতে হয় জাতীয় দলে। কিন্তু স্বপ্নের সিড়ি পেয়ে নাহিদ যে গতিতে দৌড়েছেন, অনেক বাঁকেই তাঁকে থামতে হয়নি; সোজা চলে এসেছেন স্বপ্নের দরজায়।
একাডেমিতে আলমগীর কবীরের নজরে পড়েন নাহিদ, তাঁকে নিয়ে কাজ শুরু করেন জাতীয় দলের সাবেক এই ক্রিকেটার। সেখান থেকে ডাক পড়ে অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ক্যাম্পে, ছিলেন বিশ্বকাপের স্কোয়োডের বিবেচনাতেও। কিন্তু শেষ মুহূর্তে গিয়ে বাদ পড়েন, বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে তাঁর পথচলা এতোটুকুই। বিভিন্ন সময়ে নেটে বোলিং করতে গিয়ে নাজমুল হোসেন শান্ত, জহুরুল হক অমিদের নজরে পড়েন তিনি। তাঁরা ডেকে খেলান প্রথম শ্রেণির টুর্নামেন্ট জাতীয় ক্রিকেট লিগে (এনসিএল)।
অভিষেকের অধ্যায়ে দুটি ম্যাচ খেলা নাহিদ টুর্নামেন্টটির পরের আসরে রীতিমতো শাসন করেন। ৬ ম্যাচে নেন ৩২ উইকেট, যা ছিল এনসিএলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। তারপর এনসিএল, বিপিএল হয়ে এখন জাতীয় দলে অভিষেক হয়ে গেল তাঁর।
ক্রিকেটে সমর্থন ছিল না নাহিদের পরিবারের। শর্ত পূরণ করে একাডেমিতে ভর্তি হতে হয় তাঁকে। শর্ত ছিল এসএসসি পরীক্ষায় কৃতকার্য হতে পারলে একডেমিতে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হবে। ক্রিকেটকে ধ্যান-জ্ঞান বানিয়ে ফেলা নাহিদ এটাকেও চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেন, এসএসসিতে কৃতকার্য হন। পেশাদার ক্রিকেটে নাম লেখানোর শুরুর অধ্যায় নিয়ে নাহিদ বলেন, ‘আমি ক্লেমন ক্রিকেট একাডেমিতে ভর্তি হই, তখন আমার বয়স ১৮ বছর। এর আগে আমি পাড়ার ক্রিকেট খেলতাম। টেপ টেনিস, ফাইভ স্টার বলে খেলতাম।’
‘ওখানে ভর্তি হওয়ার পর আলমগীর কবীর স্যারের চোখে পড়ি। ওখান থেকে উনার সঙ্গে কাজ করতে করতে এতো দূর উঠে আসা। বয়সভিত্তিকে শুধু অনূর্ধ্ব-১৯ এর ক্যাম্প করেছি। আমি ক্রিকেটের জন্য পাগলের মতো ছিলাম, কিন্তু শুরুতে পরিবারের না ছিল। বোঝাতে ব্যর্থ হয়ে আমাকে ক্রিকেট একাডেমিতে ভর্তি করায়। আমাকে শর্ত দিয়েছিল, ‘তুমি যদি এসএসসি পাস করতে পারো, তাহলে ভর্তি করিয়ে দেব।’ এসএসসি পাস করার পরে ভর্তি করিয়ে দেয়। এখন সবাই সমর্থন করেন।’ যোগ করেন তিনি।

খুব কাছে গিয়ে যুব বিশ্বকাপের স্কোয়াডে জায়গা মেলেনি নাহিদের। হতাশ না হয়ে নতুন শুরু করেন তিনি, কাজ শুরু নিজের দুর্বলতা নিয়ে। জীবনের এই পর্বটাকে শিক্ষার বড় অধ্যায় মনে করেন নাহিদ, ‘হতাশা কাজ করেনি। কারণ ওই বাদ পড়াতে আমার আরও ভালো হয়েছে যে, নিজেকে নিয়ে কাজ করার তাড়া অনুভব করেছি। মনে হয়েছে বাদ পড়েছি, আমার মধ্যে যে ল্যাকিংস আছে, তা নিয়ে কাজ করি। বাদ পড়ে বরং অনেক শিখেছি, এখান থেকে অনেক শিক্ষা নিয়েছি।’
এনসিএল, বিপিএল হয়ে জাতীয় দল। পুরো সফরটি কেমন ছিল, কাদের নজরে পড়ায় সুযোগ মেলে; এসব সম্পর্কে জানাতে গিয়ে নাহিদ বলেন, ‘আমি তো আগে থেকেই জোরে বোলিং করতাম। এভাবে করতে করতে শান্ত ভাই, জহুরুল ইসলাম অমি ভাইরা দেখেছেন। এরপর উনারা আমাকে এনসিএলে ডাকেন, ওখানে ভালো করি। এরপর পথটা সহজ হয়ে যায়। এইচপির ক্যাম্পে ডাক পাই। পরের বছরও এনসিএল ভালো যায়, এরপর বিপিএল, এখন তো জাতীয় দলের সঙ্গে।’
পেসার হতে হবে, গতিতে বল করতে হবে, এমন ভাবনা কখনও কাজ করেনি নাহিদের মাঝে। সেই ছোট্ট বেলায় হাতে পাওয়া একটি টেনিস বল তাকে পেসার বানিয়ে দেয়, ‘কোনো ভাবনা নয়, এটা কখনও মাথায় আসেনি যে পেসার হবো। আমি তখন ছোট, তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি। ওই সময়ে আমি খেলতাম না, বোলিংও করতাম না। তখন একটা টেনিস বল হাতে পাই আমি। বলটা পেয়ে বোলিং করতাম। নিজে নিজেই বোলিং করতে করতে শুরুটা হয়ে যায়। এরপরে দেখলাম বেশ জোরে বোলিং করতে পারি, তাহলে আরেকটু চেষ্টা করে দেখি। সেই চেষ্টা করতে করতেই আজ এখানে চলে এসেছি।’
ক্রিকেটে নাহিদের কোনো আদর্শ ক্রিকেটার নেই, কাউকে অনুসরণ না করে নিজের মতোই ‘বিশেষ’ থাকতে চান তিনি। বাংলাদেশের পেসারদের বোলিং পছন্দ করা তরুণ এই পেসার ছুঁতে চান ১৫০ কি.মি। তিনি বলেন, ‘আমার এমন কোনো আদর্শ ক্রিকেটার বা পেসার নেই, যাকে আমি অনুসরণ করি। বাংলাদেশের তো সবার খেলাই ভালো লাগে, কারণ তাদের দেখে ছোট থেকেই খেলাটার প্রতি আবেগ-ভালোবাসা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের পেস বোলারদের অনেক ভালো লাগে।’
‘গতি আমার অন্যতম হাতিয়ার, তবে আপাতত শুধু গতি নিয়ে ভাবছি না। আমার একটাই ইচ্ছা, দলকে ভালো কিছু দিতে চাই। শুধু গতি নিয়ে এই মুহূর্তে ভাবছি না। গতির ব্যাপারটি আমার ক্ষেত্রে প্রকৃতিপদত্ত, এমনিই হয়ে যাবে আশা করি। এতো জোরে করতেই হবে, এমন কোনো লক্ষ্য নেই। তবে একেবারেই কাছে চলে গিয়েছিলাম, সেই হিসেবে ১৫০ কি. মি ছোঁয়ার ইচ্ছা তো অবশ্যই আছে। আশা করি এটা হয়ে যাবে।’ বলেন তিনি।
গতি আছে, কিন্তু নিজের লাইন-লেংথ নিয়ে সন্তুষ্ট নন নাহিদ। তাই যে কোচকেই সামনে পান, তার সঙ্গে কাজের বিষয়বস্তু থাকে এটাই, ‘অনেক কিছু নিয়ে কাজ করার আছে। আমার ক্যারিয়ার তো মাত্র শুরু। সামনে যতো আগাবো, ততো শিখব। এই মুহূর্তে লাইন, লেংথ নিয়ে কাজ করছি। এটায় যতো নিয়ন্ত্রণ আসবে, ততো ভালো হবে। শুধু গতি থাকলেই তো হবে না, ঠিক জায়গায় বল ফেলতে হবে। লাইন-লেংথ নিয়ে আমি সব সময়ই কাজ করি। যে কোচকে সাথে পাই, তার সঙ্গেই কাজ করি। যেকোনো ক্যাম্পে কোচের সঙ্গে কাজ করি।’
নাহিদের বড় সম্পদ তাঁর উচ্চতা। নিজের উচ্চতার কারণে সহজাত বাউন্স পান। আর সেটিকেই তিনি অস্ত্র বানিয়ে ব্যাটারদের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ান। ডেলিভারি হ্যান্ড সোজা, পেয়ে যান কিছু বাড়তি মুভমেন্ট। লাইন লেংথ নিয়ে কাজ করলে বাংলাদেশের ক্রিকেটে দুর্দান্ত এক পেসার হতে পারেন তিনি।
পেসারদের গতির বিপরীতে ইনজুরিও উঁকি দেয় আড়ালে। সেই বাস্তবতা রানারও আছে। অ্যাকশনও ঝুঁকিপূর্ণ। তবে, সে সব কিছুকেই মাথায় রেখে আগামীর পথে সম্মুখপানে এগিয়ে চলতে হবে নাহিদ রানাকে। আর রানা যত এগিয়ে যাবেন, যতই উপকৃত হবে বাংলাদেশ দল।