২৭ জুলাই ২০২৪

বুয়েট ও ভর্তিচ্ছুদের একগুচ্ছ স্বপ্ন

মিনহাজুল ইসলাম শান্ত
২০ জানুয়ারি ২০২৪, ১৮:০০
বুয়েট শিক্ষার্থী আফিয়া সিদ্দিকা রাঈসা। অলংকরণ : কিশোর ডাইজেস্ট

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে যাঁরা ভর্তি হতে চান, তাঁরা ইতিমধ্যে জোর প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছেন। কোনও সন্দেহ নেই বুয়েট ভর্তি পরীক্ষা বাংলাদেশের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা। ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণে শিক্ষার্থীদের জন্য নিজের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন বুয়েট শিক্ষার্থী আফিয়া সিদ্দিকা রাঈসা। কিশোর ডাইজেস্টের পক্ষে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিনহাজুল ইসলাম শান্ত।

বুয়েটে পড়বেন, এ স্বপ্ন কবে থেকে দেখা শুরু করেছিলেন?

আফিয়া সিদ্দিকা রাঈসা : মূলত এসএসসির পর ভাবতে থাকি বুয়েটে পড়ব। নাইন-টেনে বুঝতে পারি, আমার গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানের সমস্যা সমাধান করতে বেশ ভালো লাগে। দক্ষতা ভালো বলে টিচাররা প্রশংসা করতেন। পাশাপাশি, ইন্টারে ম্যাথ সায়েন্স যাঁর কাছে পড়তাম, তিনিও বুয়েটের স্টুডেন্ট ছিলেন। তাঁকে দেখে আগ্রহ জাগত। আর আমার বাবা বুয়েটে পড়তে চেয়েছিলেন, কিন্তু সেটা হয়ে ওঠেনি। সব মিলেই বুয়েটে পড়ার প্রতি আগ্রহ জন্মে। তবে এ কথা বলে রাখাটা আমার নৈতিক দায়িত্ব যে, আমি কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিং ভালোবেসে বুয়েটে পড়তে আসিনি, যেটা আসলে হওয়া উচিত ছিল। এক্ষেত্রে যেটা আসলে কন্ট্রিবিউটিং ফ্যাক্টর, আমাদের দেশের ইনস্টিটিউট সেন্ট্রিক সাবজেক্ট প্রিফারেন্স টেন্ডেন্সি ওভার সাবজেক্ট সেন্ট্রিক ইনস্টিটিউট প্রিফারেন্স টেন্ডেসি ব্যাপারটা একটু খোলাসা করে বলি। খেয়াল করলে তোমরা সবাই দেখবে, আমাদের এখানে ম্যাক্সিমাম স্টুডেন্টরাই আগে ইনস্টিটিউট চুজ করে, এরপর সেই ইনস্টিটিউটের আন্ডারে সাবজেক্টগুলো আছে তার মধ্যে একটা বাছাই করে নেয়। অথচ ব্যাপারটা কিন্তু হওয়ার কথা ছিল উল্টো, আগে সাবজেক্ট স্পেসিফাই করে তারপর ইনস্টিটিউট সিলেকশনে যাওয়া। সবার আগে একজন মানুষকে নিজের এপ্টিটিউড, মোটিভেটশন জানতে হবে। পাশাপাশি ক্যারিয়ারিস্টিক চিন্তাভাবনা কর‍তে হবে।

আমার আর একটা ধারণা ছিল ম্যাথ-ফিজিক্স ভালো পারলে তো সবাই ইঞ্জিনিয়ারিংই পড়ে। কিন্তু এখানে একটা ভুল ধারণা আছে। ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাডমিশন প্রিপারেশনের আগে প্রতিটা ইঞ্জিনিয়ারিং সাবজেক্ট নিয়ে একটা বেসিক ধারণা নিয়ে এটা ঠিক করা জরুরি যে, আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চাই কি না, পড়লে কোনটা পড়তে চাই। ইঞ্জিনিয়ারিং মানে ম্যাথ-ফিজিক্সের সমাধান না। হ্যাঁ, আমরা ইঞ্জিনিয়ারিং সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে ম্যাথ-ফিজিক্স অ্যাপ্লাই করি, কিন্তু যে সমস্যাগুলো আমরা সমাধান করি সেগুলো কিন্তু পিওর ম্যাথ-ফিজিক্সের সমস্যা না; এখানে ম্যাথ-ফিজিক্সের ব্যবহার একটা টুল। সুতরাং কোন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়লে আমাকে কী ধরনের সমস্যা সমাধান করতে হবে, এটা বোঝা জরুরি।

এইচএসসি পরীক্ষার পর আপনি কীভাবে ভর্তি প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেন, ভর্তি কোচিং কি একজন শিক্ষার্থীর জন্য জরুরি?

আফিয়া সিদ্দিকা রাঈসা : সত্যি বলতে, পড়া আসলে নিজের কাছে। মূল পাঠ্যবই, বিগত বছরের প্রশ্ন সমাধানের ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। বুয়েট অ্যাডমিশন টেস্টে ব্যাপারটা কখনোই এমন হবে না যে, কিছু প্রশ্ন সমাধান করে গেলাম, কমন পেয়ে যাব। তাই প্রস্তুতিটা এমন হবে, যেমন যে কোনও ধরনের সমস্যা সমাধানের কৌশলটা এমন হওয়া উচিত, প্রথমে সমস্যাকে ফিল করা, ভিজুয়ালাইজ করা, actually what's going on? যখন কেউ টোটাল সিস্টেমটা বুঝতে পারবে, তখন তাকে যেভাবেই সেই সিস্টেমটা নিয়ে চিন্তা করতে বলা হোক না কেন, তার পক্ষে চিন্তা করে যে কোনও সমস্যার সমাধান করা সম্ভব, এটলিস্ট থট প্রডিউস করে প্রসিড করা সম্ভব।

আসলে, যে কোনও সফলতার পেছনে মানুষের উইল পাওয়ারের ভূমিকা সবার আগে। কেউ যদি কিছু একটা করতে চায়, তাহলে যেভাবেই হোক একটা ওয়ে বের করে সেটা এচিভ করবেই। বুয়েট অ্যাডমিশনের ক্ষেত্রে কোচিংয়ের রোল যে কারণে আসে, আমাদের উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থার অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে, উচ্চমাধ্যমিকে ভালো ফলাফলের জন্য যে পরিমাণ ইন ডেপথ স্টাডির প্রয়োজন হয়, বুয়েট ক্র্যাক করার জন্য এর চেয়ে অনেক বেশি ইন ডেপথ স্টাডির প্রয়োজন হয়, যেটা আসলে এক্সটার্নাল মেন্টরিং ছাড়া করা কঠিন, আমার মতে। আরেকটা বড় পয়েন্ট হলো, কোচিংগুলোকে ডেইলি, উইকলি অ্যাসেসমেন্ট, বিষয়ভিত্তিক পরীক্ষা হয়, এগুলো অ্যাটেন্ড করা জরুরি, এগুলো অ্যাডমিশন টেস্টের ধাঁচে হয়ে থাকে। একই ধরনের স্ট্রাকচার ও ডিজাইনে পরীক্ষা দেওয়ার অভ্যাস না থাকলে অ্যাডমিশন টেস্টে গিয়ে সমস্যা হওয়ার ভালো সম্ভাবনা থাকে। তবে কোচিং ছাড়া কেউ যে বুয়েট ক্র্যাক করতে পারবে না, সেটাও আমি মনে করি না। এখন ইন্টারনেটের যুগে ইউটিউবেই প্রচুর ফ্রি কনটেন্ট পাওয়া যায়, যেখান থেকে সব টপিকে ক্লিয়ার কনসেপ্ট পাওয়া সম্ভব। কারও আগ্রহ থাকলে এই রিসোর্সগুলো ব্যবহার করে বুয়েট ক্র্যাক করা সম্ভব।

ভর্তি পরীক্ষা। ফাইল ছবি

বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষায় ভীষণ প্রতিযোগিতা। অনেকে মানসিকভাবে প্রতিযোগিতা ভয় পায়। মানসিকভাবে হতাশ হয়ে যায়। নিজেকে মানসিকভাবে শক্তিশালী করার উপায় কী মনে করেন?

আফিয়া সিদ্দিকা রাঈসা : ব্যক্তিগতভাবে বুয়েট অ্যাডমিশন নিয়ে এক্সেসিভ ক্রেইজ অ্যান্ড কম্পিটিশন আমার পছন্দ নয়। It should be like this, keeping me sound, I can try for best. একটা প্রতিযোগিতা চেইজ করতে গিয়ে আমি যদি ভালো থাকতে না পারি, তবে এই প্রতিযোগিতা চেইজ করার অর্থ কী? আমরা তো জীবনের জন্য পড়াশোনা করি, পড়াশোনার জন্য তো জীবন নয়, তাই না? আমাদের এভাবে ভাবা উচিত, life will provide me lots of opportunities, there must be ways as an alternative of another. ব্যাপারটা হওয়া উচিত এমন, আমার চেষ্টাটা আমি করে যাই, ফলাফল যা আসুক, তার মধ্যে যেটা ভালো হবে I'll accept it.

এক্ষেত্রে আসলে অভিভাবককের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। আমি আমার এমন অনেক ক্লাসমেটদের দেখেছি, যাদেরকে তাদের প্যারেন্টস পড়াশোনা নিয়ে রীতিমতো টর্চার করতেন, এক্ষেত্রে অভিভাবকের বলব, আপনারা তো বাচ্চার ভালোর জন্য সে পড়াশোনায় ভালো হোক, চাচ্ছেন। কিন্তু আপনার এই ভালো চাওয়া থেকে উদ্ভূত বাচ্চার ওপর পড়া গগণচুম্বী স্ট্রেস, উল্টো বাচ্চার ক্ষতি করছে কি না, এগুলো ভেবে দেখার অনুরোধ রইল।

বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের জন্য বিষয়ভিত্তিক প্রস্তুতি কীভাবে নেওয়া উচিত মনে করেন, কোন বিষয় বা টপিকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে?

আফিয়া সিদ্দিকা রাঈসা : বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের জন্য আসলে গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন; তিনটি বিষয়ের সমান গুরুত্ব দিতে হবে। যে কোনও জায়গা থেকে প্রশ্ন আসতে পারে, তাই সবকিছুতেই কন্সেপচুয়ালি ক্লিয়ার থাকতে হবে। যেহেতু পরীক্ষায় একটি সমস্যা সমাধানের জন্য গড়ে ৩ মিনিটের মতো সময় পাওয়া যায়, তাই প্রচুর প্র্যাকটিস করে চিন্তা ও স্পিডের দক্ষতা বাড়াতে হবে। আর একটা জিনিস, প্রিপারেশন নিতে গিয়ে বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের সময় যে ভুলগুলো করছ, এগুলো নোট রাখা জরুরি, এতে করে অনেক সুবিধা হয়।

পরীক্ষার আগে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি হিসেবে আপনি কী কী করেছিলেন?

আফিয়া সিদ্দিকা রাঈসা : শেষ মুহূর্তে এসে নতুন কিছু পড়ার চেষ্টা করিনি। আগে যা পড়েছি, সেগুলোই গো থ্রু করে গেছি। বিভিন্ন চ্যাপ্টারের সূত্রাবলি, আগে ভুল করতাম এমন সমস্যাগুলো, দেখে গেছি। কিছু এক্সাম দিয়েছি, যাতে করে এক্সাম ফোবিয়া কাটে।

প্রচুর পড়াশোনা করার পরও বুয়েটে যদি কারও চান্স না হয়, তার জন্য আপনার কী পরামর্শ থাকবে?

আফিয়া সিদ্দিকা রাঈসা : প্রথমেই যে জিনিসটা মনে রাখতে হবে, বুয়েট কোনও আল্টিমেট ডেস্টিনেশন না। It's just an institute. নিজের পছন্দমতো সাবজেক্ট নিয়ে, ডেডিকেটেডলি পড়াশোনা করলে, তুমি যেখান থেকেই পড়ো না কেন, you'll shine. ইম্পরট্যান্ট জিনিসটা হলো তোমার নলেজ অ্যান্ড স্কিল। হ্যাঁ, টপ ইনস্টিটিউটে পছন্দের সাবজেক্টে পড়লে সুযোগ-সুবিধার সম্ভাবনা বেশি থাকে, তবে কোনও কারণে চান্স না পেলে যে জীবন গোল্লায় যাবে, ব্যাপারটা মোটেই এমন নয়। আরেকটা ব্যাপার যেটা, তুমি যদি বুয়েটে চান্স পাওয়াটাকে তোমার জীবনের লক্ষ্য ভাবো, তাহলে সেটা ভুল। এক্ষেত্রে লক্ষ্যটা হওয়া উচিত, আমি বুয়েটের চান্স পাওয়ার জন্য স্টাডি করছি, একটা নলেজ অ্যান্ড স্কিল অ্যাকুয়ারিং প্রসেসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, এই জিনিসটা যে কারও জন্য একটা life-long learning. তুমি যেখানেই পড়ো না কেন তোমার এই learning-টা তোমাকে হেল্প করবেই। এখানে নলেজ অ্যান্ড স্কিলটা মেজর, getting chance at BUET is minor.

আর এখন সত্যি বলতে ইন্টারনেটের কল্যাণে নলেজ গেইন করা আমাদের হাতের মুঠোয় if we are interested. সেই নলেজ ইউজ করে কাজও করা সম্ভব। তাই আমরা যেখানেই পড়ি না কেন, কী পড়ছি, কেন পড়ছি, কীভাবে পড়ছি এই ব্যাপারগুলো বুঝে শুনে সেলফ ইম্প্রুভমেন্ট জরুরি।