
বর্তমানে পপ ইন্ডাস্ট্রিতে এক শক্তিশালী ঝড়ের নাম বিটিএস। যে ঝড়ের কবলে প্রায় দুমড়ে-মুচড়ে গিয়েছে পশ্চিমাদের রাজত্ব। আপনি এদের ফ্যান হন কিংবা না হন, বিশ্বজুড়ে মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির একটা বিশাল অংশ এখন তাদেরই দখলে। আধুনিক বিনোদন জগতে বরাবরই উন্মাদনার শীর্ষে আছে বিটিএস নামটি। সংগীতের ভিন্নধর্মী ভাষা, বার্তা ও উপস্থাপন দিয়েই দক্ষিণ কোরিয়ার সীমানা পেরিয়ে তারা সুনাম কুড়িয়েছে বিশ্বজুড়ে। তবে রাতারাতি এটি সম্ভব হয়নি। এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘ গল্প।
বিটিএস মূলত দক্ষিণ কোরিয়ার কে-পপভিত্তিক বয় ব্যান্ড। ২০১৩ সালে এটি আত্মপ্রকাশ করে। বিটিএস ছাড়াও এটি বাংটন বয়জ, বাংটন সোনিয়ন্দন, বিয়ন্ড দ্য সিন এবং বুলেটপ্রুফ বয় স্কাউট নামেও পরিচিত। বিটিএসের অরিজিন নিয়ে বলতে গেলে সবার আগে ‘Seo Taiji and Boys’ ব্যান্ড আর ‘Gangnam Style’ গানের কথা উঠে আসবে। আমরা সবাই ‘Gangnam Style’-এর নাম শুনলেও ‘Seo Taiji’ নিয়ে অনেকেই জানি না। সাউথ কোরিয়ায় নতুন ধারার গানের শিফটটা আসে ‘Seo Taiji and Boys’-এর হাত ধরেই। তাদের গানের ভেতর দিয়ে প্রথম তরুণেরা এমন কিছু একটা খুঁজে পেল, যার সাথে তারা নিজেদের জীবনকে মেলাতে পারে। এরপর সেই যাত্রায় আরও এগিয়ে দেয় ২০১২ সালের ‘গ্যাংনাম স্টাইল’ গানটি। যা কে-পপ ইন্ডাস্ট্রিকে এক নিমিষেই করে তোলে গ্লোবাল!

২০১৩ সালে বিটিএসের জন্ম হলেও এর ইতিহাস খুঁজতে গেলে ২০১০ সালে ফিরে যেতে হবে। সাউথ কোরিয়ার ‘বিগ হিট মিউজিক’ বা ‘বিগ হিট এন্টারটেইনমেন্ট’ নামে একটি মিউজিক প্ল্যাটফর্ম ছিল। এর ফাউন্ডার Bang Si-Hyuk আদতে এমন একটা মিউজিক ব্যান্ড তৈরি করতে চেয়েছিল, যাদের মূল ফোকাস থাকবে উঠতি বয়সী তরুণ। তখনকার সমসাময়িক কোনও ব্যান্ডই সে পথে এগোয়নি। তাই একটি হিপহপ গ্রুপ তৈরির উদ্দেশ্যে তিনি অডিশন নেওয়া শুরু করেন। র্যাপের সাথে গান ও নাচ নানা স্কিলে এক্সপার্ট এমন কিছু সদস্য নিয়ে ২০১৩ সালে তৈরি হয় ‘বুলেটপ্রুফ বয় স্কাউট’ সংক্ষেপে বিটিএস।
বর্তমানে বিটিএসের সদস্য সংখ্যা সাতজন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন জিম, সুগা, জে হোপ, আরএম, জিমিন, ভি ও জাংকুক। এই দলটি নিজেদের লেখা গান, নিজস্ব সুর ও নৃত্য পরিবেশনার মধ্য দিয়ে সারা বিশ্বের তরুণদের হৃদয়ে বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছে। এদের সমর্থকদের ‘আর্মি’ বলে গণ্য করা হয়। আর্মির অর্থ ‘অ্যাডোরেবল রিপ্রেজেন্টেটিভ এমসি ফর ইয়ুথ’। বিটিএসের সাফল্যের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তাদের ভক্ত ও সমর্থক। ইনস্টাগ্রামে তাদের ৭৩ মিলিয়নের বেশি ফলোয়ার আছে। টুইটারে আছে ৪৪ মিলিয়নের বেশি এবং ফেসবুকে ২১ মিলিয়ন। এমনকি বিটিএসের অফিশিয়াল ইউটিউব চ্যানেলে ১০ বিলিয়নের বেশি ভিউ হয়েছে এরই মধ্যে।
বিটিএস বা কে-পপ ইন্ডাস্ট্রির উত্থানের পেছনে কোরিয়ান সরকারের বেশ বড়সড় হাত রয়েছে। ২০০৫ সাল থেকে কোরিয়ান সরকার যেসব কোম্পানি কোরিয়ান পপ কালচারকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে চায় তাদের পেছনে বিনিয়োগ করা শুরু করে। যার ফলে কে-পপ মিউজিক ভিডিও বা কে-ড্রামাগুলো এত বড় বাজেটের মধ্যে করা সম্ভব হয়। আর মাথার ওপর সরকারের এমন ভরসার ছায়া পেয়ে বিটিএসের হাওয়া বইতে শুরু করে বিশ্বজুড়ে।

বিটিএস একে একে তাদের গানে কোরিয়ান এডুকেশন সিস্টেম, স্কুল লাইফ, মেন্টাল স্ট্রেস, লাভ লাইফ ও মেন্টাল ট্রমার মতো বিষয়গুলো তুলে আনার চেষ্টা করে, যার সম্মুখীন হয় মূলত তরুণেরা। তবে শুরু থেকে তাদের মিউজিক জনরা ছিল হিপহপ। কিন্তু হুট করে সব বদলে চলে আসে রঙিন আবর্তন। অ্যালবাম ‘Dark and wild’ থেকে শিফট হয় ‘Most beautiful moment in life’-এ। আর সাথে রঙিন ধাঁচের পোশাক তো আছেই। এরপর থেকে নতুন ধরনের সব গানের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে থাকে sentiment, hope, friendship, vulnerability আর dark reality of life, যা তরুণদের মাঝে উত্তেজনার জোয়ার নিয়ে আসতে সক্ষম হয় নিমিষেই। আর দিনশেষে তাদের বিনয়ী স্বভাব মন কেড়ে নেয় সকলের। দুর্দান্ত সব গান উপহার দেওয়ার পাশাপাশি জয় করে নেয় MTV award, Billboard, Grammys, American Music Award-সহ মিউজিক ইন্ড্রাস্টির নামিদামি সব পুরষ্কার।
কিন্তু বিটিএসের গানের প্রতি সকল প্রকার শ্রোতার আগ্রহ বাড়ার কারণ কী? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে তিনটি বিষয় সামনে নিয়ে আসতে হয়। প্রথমত, মেইনস্ট্রিমের বাইরে গিয়ে এত ফ্যানকে বগলদাবা করার একটা বড় কারণ হলো, তাদের মিউজিকে বিভিন্ন স্টাইলের হাইব্রিড মিক্স। Pop, EDM, Funk Rap, Hiphop, Ballad-এর মতো আরও ১৫টি গানের জনরা নিয়ে তারা কাজ করেছে। যার ফলে নানা ধরনের মিউজিক টেস্টের মানুষের কাছে বিটিএস খুব সহজেই চলে যেতে পারছে বলে ধারণা করা যায়। দ্বিতীয়ত, তাদের নৃত্য পরিবেশনা। বিটিএসকে আলোচনার তুঙ্গে নিতে তাদের ডান্স কোরিওগ্রাফি অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। আর এই ফিচারটি দর্শকদের কাছে গান শোনার আনন্দের পাশাপাশি একটা ‘ভিজুয়াল প্লেজার’ দেয়। যা অন্য কোনও ব্যান্ডের ক্ষেত্রে পাওয়া যায় না। তৃতীয়ত, তাদের ফ্যাশন সচেতনতা ও লাইফস্টাইল। বিটিএসের ওয়্যারড্রব কালেকশন বেশ চোখে পড়ার মতো। আগে তারা ফ্যাশনে হিপহপ ঘরানাকে প্রাধান্য দিলেও বর্তমানে তারা বেছে নিচ্ছে এ যুগের ক্যাজুয়াল জামাকাপড়। মজার ব্যাপার হলো, যে কোনও বিটিএস মেম্বার যেই শার্ট একবার পড়ত, পরের দিনই মার্কেটে সেটা হয়ে যেত সোল্ড আউট!
অন্যান্য কে-পপ ব্যান্ড থেকে বিটিএস আলাদা হওয়ার কারণ হলো, তাদের গানের ভেতরকার ‘হিডেন স্টোরিলাইন’। ফ্যানরা নিজেদের মতন রিসার্চ করে নানা হিডেন থিওরি বের করে। তাই ইন্টারনেটে সার্চ করলে একটা ভিডিওর হাজারটা স্টোরিলাইন বের হয়ে আসবে, যার সবগুলোই ফ্যানদের বের করা। মোদ্দাকথায়, বিটিএসের মেধা, মনন, বিনয়, কঠোর পরিশ্রম, সোশ্যাল ইস্যু নিয়ে কথা বলা, ফ্যানদের সাথে কানেকশন সবকিছুই তাদের অন্য কে-পপ ব্যান্ড বা শিল্পীদের থেকে আলাদা করে রেখেছে।

এবার একটু টাকাপয়সার হিসাবে আসা যাক। বিটিএস সদস্যরা তাদের গান, অ্যালবাম বিক্রি, কনসার্ট, ব্র্যান্ড ডিল ও মার্চেন্ডাইজ দিয়েই বড় অঙ্কের অর্থ আয় করে। ২০২০ সালে ‘Map of the Soul 7’ নামের অ্যালবাম প্রথম সপ্তাহেই প্রায় ৪.২ মিলিয়ন কপি সেল করে, যেটা এক বিশাল রেকর্ড! এরপর ২০১৮ সালে ‘Love yourself in Seoul’ নামে যেই ওয়ার্ল্ড ট্যুর দিয়েছিল, শুধু সেটা দিয়েই তারা নিয়ে আসে প্রায় ১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। সাউথ কোরিয়ার ইকোনমির মতে, হিসাব করলে বছর ঘুরে বিটিএসের মোট আয় দাঁড়ায় প্রায় ৩.৬ বিলিয়ন ডলার। এর প্রভাব পড়েছে কোরিয়ার ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রিতেও। কারণ, প্রতি বছর প্রায় ৪ লাখ ট্যুরিস্ট সাউথ কোরিয়াকে বেছে নেয় শুধু বিটিএসের জন্য।
বিটিএস কিন্তু এই পর্যায়ে একদিনে আসেনি। এত সাফল্য দেখে যদি মনে করে থাকেন কে-পপ আইডলদের জীবন সোনায় সোহাগা, তাহলে হয়তো ভুল ভাবছেন। এজেন্সিগুলোতে তরুণ বয়সেই যখন ছেলেমেয়েরা ঢোকে, তখন থেকেই শুরু হয় কঠোর ট্রেনিং। যার আওতায় পরে ম্যানার, সেলফ-গ্রুমিং, ডায়েট, আউটফিট এমনকি প্রয়োজন হলে করতে হতে পারে প্লাস্টিক সার্জারিও! এ ছাড়া বিটিএস ব্যান্ডের ম্যানেজার আর্টিস্টদের লাইফস্টাইলে অনেক বিধিবিধান দিয়ে দেন। যার কারণে আপনি কখনও বিটিএস সদস্যদের রোমান্টিক পাবলিক রিলেশনশিপে দেখতে পাবেন না। বিটিএস লাইভ শোতেও দুর্দান্ত পারফর্ম করে। আর প্রতিটি পারফরম্যান্সকে সঠিক করতে তারা কমপক্ষে ১২-১৫ ঘণ্টা অনুশীলন করে থাকে।

বিটিএসের দৌড় শুধু গানেই সীমিত থাকেনি। বর্তমানে দলবেঁধে বিশ্বের অনেক জায়গায় ভ্রমণ করছে। এমনকি জাতিসংঘেও গান পরিবেশন করেছেন তাঁরা। দলটি ইউনিসেফের সাথে #ENDviolence প্রচারাভিযান এবং ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনে তাঁদের সাম্প্রতিক এক মিলিয়ন ডলার অনুদানসহ সমালোচনামূলক সামাজিক বিষয়গুলো মোকাবেলায় ধারাবাহিকভাবে তাঁদের প্ল্যাটফর্মটি ব্যবহার করেছেন।
সংগীত ইতিহাসে একটি অনুপ্রেরণার নাম বিটিএস। মঞ্চ থেকে শুরু করে মানুষের হৃদয়ে তাদের প্রভাব সমানভাবে বিস্তৃত। বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে পৌঁছেছে তাদের বার্তা, সান্ত্বনা, অনুপ্রেরণা, ঐক্য ও বিজয়ের গল্প। তাই দিনশেষে বিটিএসকে ঘিরে থাকা উন্মাদনার মাঝে আমরা শুধু সুরের মূর্ছনাই নয়, একটি আন্দোলন, আশার আলো ও প্রতিবাদের জ্বলন্ত শিখাও খুঁজে পাই।