
একটা বই পড়ছি, এমন সময় আম্মুর ডাক। অগত্যা পৃষ্ঠা ভাঁজ করে না হয় হাতের কাছে যা থাকে তা-ই বুকমার্ক হিসেবে ব্যবহার করে উঠে পড়তে হয়। কেউ পাতার কোনা ভাঁজ করে, কেউ স্টিকি নোটস দিয়ে বইয়ে চিহ্ন দিয়ে থাকে। এ প্রসঙ্গে শিক্ষার্থী মারইয়াম মাহফুজ বলেন, ‘বাবাকে দেখতাম স্কচটেপ লাগিয়ে রাখতেন বইয়ের কোনায়, এখনকার স্টিকি নোটস যেমন।’
আমার মতো বইয়ের পাতা নষ্ট করতে ওস্তাদ যেমন আছে, তেমনই প্রিয় বইটায় সুন্দর বই-চিহ্ন ব্যবহারের লোকও নেহাত কম নয়। আজ তাই কথা হবে বুকমার্ক নিয়ে।
জানা ইতিহাস বলছে, বুকমার্কের প্রথম রেফারেন্স পাওয়া যায় ম্যারি রাসেল মিটফোর্ডের ‘Recollection of a Literary life’ (১৮৫২)-এ। যেখানে তিনি বুকমার্ককে সংক্ষেপে ‘মার্কার’ হিসেবে লিখেছেন, ‘I had no marker and the richly bound volume closed as if instinctive.’
সহজ ভাষায় বুকমার্ক হলো একটি পাতলা মার্কিং টুল, যা সাধারণত কার্ড, চামড়া বা ফেব্রিক দিয়ে তৈরি হতে পারে। এর প্রয়োজনীয়তা ধরা পড়ে ষোড়শ শতকের প্রথম দিকে। বইপ্রেমীদের এমন কিছু দরকার ছিল, যা তার বইয়ের ক্ষতি করবে না; কিন্তু রেখে যাওয়া পৃষ্ঠাটি সহজে খুঁজে বের করবে। জানা যায়, রানি এলিজাবেথ প্রথম ছিলেন শুরুর দিককার বুকমার্ক ব্যবহারকারীদের একজন।
ষষ্ঠ শতাব্দীতে একটি কপ্টিক কডেক্সের ভেতর পাওয়া যায় প্রথম বুকমার্কটি। চামড়া দিয়ে তৈরি বুকমার্কটি আবিষ্কৃত হয় মিসরে। ১৮৬০ সাল নাগাদ ইংল্যান্ডের কভেন্টিতে আকর্ষণীয় মেশিনে তৈরি হয়েছিল বুকমার্ক। ১৮৬২ সালে সিল্ক কাপড়ে বোনা সচিত্র বুকমার্ক বানাতেন টমাস স্টিভেন, যা স্টিভেনগ্রাফ নামে পরিচিত হয়েছিল।

বর্তমানে বইয়ের বাজারে বাড়ছে বুকমার্কের চাহিদা। পাঠক চায় তার বইয়ে থাকুক নান্দনিকতার ছোঁয়া। তাই সে ব্যবহার করছে নানারকম বই-চিহ্ন। এখন অনেক বইয়ের দোকানই নতুন বইয়ের সাথে বুকমার্ক উপহার দিয়ে থাকে। পাশাপাশি বিক্রি করে থাকে প্রিমিয়াম কোয়ালিটির বুকমার্ক।
‘বইনগর’ বর্তমানে জনপ্রিয় একটি অনলাইন বুকশপ। পাঠকপ্রিয় সব চরিত্র নিয়ে তারা বের করেছে ১৬টি বুকমার্কের একটি সেট। সেখানে ফেলুদা থেকে শুরু করে হ্যারি পটার—আপনার সব প্রিয় চরিত্রের দেখা পাবেন। চাইলে নিজের পছন্দের ডিজাইন দিয়ে বানিয়ে নিতে পারেন বুকমার্ক।
অনলাইনভিত্তিক পেজ ‘বুকমার্কস.বিডি’ কার্টিজ পেপারে বিক্রি করে থাকে কাস্টমাইজড বুকমার্ক। তাঁরা জানান, পাঠক চাইলে যে কোনও লেখা দিয়ে বুকমার্ক বানিয়ে নিতে পারবেন। ফিতাসহ কিংবা ফিতা ছাড়া এসব বুকমার্কের দাম ২৫ থেকে ৪০ টাকার মধ্যে।
শুধু কাগজের নয়, ভিন্ন ধরনের বুকমার্কেও আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। তেমনই একটি হলো ম্যাগনেটিক বুকমার্ক। ক্রেতাদের জন্য নতুন কিছু করার তাগিদেই ২০১৯ সাল থেকে ম্যাগনেটিক বুকমার্ক নিয়ে গবেষণা করছে ‘Kraftz’। স্থায়িত্ব বজায় রাখার পাশাপাশি পাঠককে কাগজের অনুভূতি দেওয়ার জন্য তারা নিজেরাই তৈরি করেছে ৯০০ জিএসএমের বোর্ড। এই বুকমার্ক এখন তাদের সর্বাধিক বিক্রিত পণ্য। অনলাইন ছাড়াও ইউনিমার্ট, বুক ওয়ার্মের আউটলেটেও পাওয়া যাচ্ছে এগুলো।
ভিনটেজ স্টাইলের বুকমার্ক পাওয়া যাবে ‘খাম’-এর পেজে। হাতে বানানো এই বুকমার্কগুলোর দাম ২৫ থেকে ৩০ টাকার মধ্যে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, খামের কর্ণধার সুবর্ণ সন্ধ্যা বলেন, ‘অন্যান্য পেজগুলোর তুলনায় আমার বুকমার্কের দাম কম এবং এর চাহিদাও রয়েছে বেশ।’

বড় বড় বইয়ের দোকান থেকে শুরু করে ছোট স্টেশনারি দোকানেও এখন পাওয়া যাচ্ছে বুকমার্ক। বাতিঘরে আপনি পেয়ে যাবেন ভ্যান গঘের বিখ্যাত ‘স্টারি নাইটস’ থেকে অনুপ্রাণিত বুকমার্ক সেট। তেমনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্যাডো প্রাঙ্গণে দ্যু প্রকাশনীর বুকমার্কগুলো বিক্রি হয় ২৫ টাকায়।
চাইলে আপনি নিজেই বানিয়ে নিতে পারেন আপনার বুকমার্কটি। কথা হয়েছে মনোবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী কাশফিয়া তাসনিমের সাথে। নিজেই তৈরি করেন বুকমার্ক। তিনি জানান, ‘ফেসবুকে অনেক বুকমার্ক দেখেছি, কিন্তু দামের কারণে কেনা হচ্ছিল না। তাই গুগল থেকে নিজে বানানো শিখে নিয়েছি।’ পমপম বুকমার্ক, টার্সেল বুকমার্কসহ নানাবিধ বুকমার্ক ঘরে বসেই বানিয়ে নেওয়া যায়।
বুকমার্ক সংগ্রহ হয়ে উঠেছে শখের বিষয়। বইয়ের ভাঁজে রাখা চিহ্নগুলো ব্যক্তিগত পছন্দের পরিচয় দিয়ে থাকে। এখন পর্যন্ত ৫০টির অধিক বুকমার্ক সংগ্রহে আছে আইমান আয়াতুল্লাহর কাছে। তিনি জানান, ‘বই যেমন আমার কাছে খুব প্রিয়, তেমনই বুকমার্কও আমার খুব প্রিয়।’ আবিদ খান বুকমার্ক দিয়ে বই পড়তে পছন্দ করেন। বলেন, ‘আমার তো প্রতিটি বইয়ের মধ্যে একটা করে বুকমার্ক রাখার অভ্যাস হয়ে গিয়েছে।’
উপহার হিসেবে বুকমার্ক হতে পারে দারুণ কিছু। বইপ্রেমী বন্ধুটিকে তার প্রিয় চরিত্রের বুকমার্ক দিয়ে চমকে দিতে পারেন চাইলেই অথবা উপহার দিতে পারেন নিজেকেও।