
যুগ যুগ ধরেই আইনশাস্ত্র জ্ঞানজগতের অপরিহার্য শাখা হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে। একসময় অভিজাত ও উচ্চবিলাসী শ্রেণির মানুষেরা আইন বিষয়ে অধ্যয়ন করত। বর্তমান সময়েও আইন বিষয়টির গুরুত্ব ফিকে হয়নি, বরং দেশে-বিদেশে উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রে এটি অন্যতম অগ্রাধিকার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে ভর্তি পরীক্ষায় যারা মেরিটে প্রথম দিকে থাকে, তারাই আইন বিষয়টি নিয়ে থাকে। গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টির পড়াশোনা ও ক্যারিয়ার তুলে ধরছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের শিক্ষার্থী শাহ বিলিয়া জুলফিকার।
পড়ার যোগ্যতা ও প্রস্তুতি
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করার পর মানবিক, বাণিজ্য ও বিজ্ঞান শাখার শিক্ষার্থীরা ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে মেধাক্রম ও যোগ্যতা অনুযায়ী আইন বিভাগে পড়ার সুযোগ পেয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে একজন শিক্ষার্থীর উচিত উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পরই কাঙ্ক্ষিত বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে দেওয়া। যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ না হয়, তাহলে অন্য বিষয়ে পড়াশোনার পর আইন কলেজে অধ্যয়ন করে একটি এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করে আইন পেশায় আসা। তবে প্রত্যেকের উচিত প্রস্তুতি নিয়ে ভালোভাবে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা, যাতে যে কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করতে পারে।
যেখানে পড়ানো হয়
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সূচনালগ্ন থেকেই আইন বিভাগের যাত্রা শুরু হয়। আইন বিষয়ের ব্যাপক চাহিদা থাকায় বাংলাদেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়ে পড়ার সুযোগ রয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠন-পাঠন রয়েছে। এ ছাড়া দেশের অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন ল-কলেজে এ বিষয়টি পড়ানো হয়।
যা পড়ানো হয়
আইন বিষয়ে পড়াশোনা করতে হলে একজন শিক্ষার্থী ‘জুরিসপ্রুডেনস’, সাংবিধানিক আইন, মুসলিম আইন, হিন্দু আইন, চুক্তি আইন, টর্ট আইন, ভূমি আইন, প্রশাসনিক আইন, কোম্পানি আইন, বাণিজ্যিক আইন, সম্পত্তি হস্তান্তর আইন, সাইবার ল, রেজিস্ট্রেশন আইন, পরিবেশ আইন, আয়কর আইন, সুনির্দিষ্ট কার্য-সম্পাদন আইন, ইক্যুইটি ট্রাস্ট, শ্রম আইন, অপরাধ আইন, দেওয়ানি কার্যবিধি, ফৌজদারি কার্যবিধি, সাক্ষ্য আইন, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি আইন, আন্তর্জাতিক আইন, মানবাধিকার আইন, ক্রিমিনোলজি, রিয়েল এস্টেট আইন, সমুদ্র আইন, আন্তর্জাতিক সংগঠন, রিফুজি ল ও গুড গভর্নেন্সসহ ইত্যাদি নানা বিষয়ে পড়ানো হয়। স্নাতকোত্তর পর্যায়ে আরও কিছু বিশেষায়িত বিষয় পড়ানো হয়।
গবেষণা ও উচ্চ শিক্ষা
দেশের বাইরে স্কলারশিপ পেতে হলে একাডেমিক রেজাল্ট ভালো থাকা চাই। এল.এল. বি শেষ করে এল. এল. এম.-এর জন্য বাইরে যাওয়া যায়।তাছাড়া বার-এট-ল বা ব্যারিস্টারি করার সুযোগ থাকছে। ডক্টরেট এবং চাইলে মাস্টার্স করার সুযোগও পাবে স্বনামধন্য সব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এ ছাড়া বিজনেস ল, সমুদ্র আইন, সাইবার ক্রাইম, অপরাধবিজ্ঞান, পরিবেশ আইন ইত্যাদি বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের সুযোগ আছে।

চাকরির সুযোগ
আইন বিষয়ে পড়াশোনা মানেই বিচারক, অ্যাটর্নি জেনারেল, ব্যারিস্টার কিংবা অ্যাডভোকেট নয়। একজন আইনের ছাত্র গ্রাজুয়েশন শেষে পেশা হিসেবে বিসিএস, লেকচারার, ব্যাংক, বিমা, কোম্পানি, শিল্প ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ আরও বিভিন্ন চাকরির জন্য যোগ্য বলে বিবেচিত হয়। অর্থাৎ কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষার্থীরা যেসব চাকরিতে আবেদনের যোগ্য, আইনের একজন শিক্ষার্থী সেসব পদে অনায়াসেই আবেদন করতে পারে এবং প্রতিযোগিতায় উত্তীর্ণ হয়ে চাকরিতে যোগ দিতে পারে।
একমাত্র আইন পড়লেই বিসিএস ও বিজেএস দুটি ক্যাডার পরীক্ষায় একত্রে অংশ নেওয়া সম্ভব! তবে বিজেএস, বার কাউন্সিল ও বিচার-সম্পর্কিত পদগুলো শুধু আইনের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রযোজ্য। একজন আইনের শিক্ষার্থী সামরিক বাহিনীতে লেফটেন্যান্ট, সাব লেফটেন্যান্ট, ফ্লাইং অফিসার হয়ে কমিশন্ড অফিসারের পদমর্যাদায় সেনা, নৌ কিংবা বিমানবাহিনীতে ‘জাজ—অ্যাডভোকেট জেনারেল’ (JAG) কোরে যোগ দিতে পারেন। বাংলাদেশে বর্তমানে এমন ব্যাংক, বিমা, কোম্পানি, শিল্প ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান নেই, যেখানে ‘লিগ্যাল ডিভিশন’ নেই। ব্যাংকিং, কোম্পানি ও শিল্প প্রতিষ্ঠানে সাধারণ অফিসার হিসেবে আবেদনের পাশাপাশি আইন কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ লাভের এক্সট্রা সুযোগ শুধু আইনের ডিগ্রিধারীদের জন্যই সংরক্ষিত। আর যেখানেই লিগ্যাল ডিভিশন, সেখানেই ‘ল’ ডিগ্রিধারী প্রার্থীর চাহিদা।
এ ছাড়া আইনের ডিগ্রিধারীদের জন্য জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা যেমন UNHCR, UNDP, WHO, Save the Children, IOM, ILO ইত্যাদিতে আছে আইন সংশ্লিষ্ট নানান কাজের সুযোগ। বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশি দূতাবাসগুলোতেও ‘আইন কর্মকর্তা’ হিসেবে নিয়োগের সুযোগ আইনের ডিগ্রিধারীদের জন্য সংরক্ষিত আছে। দুদক, নির্বাচন কমিশন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, ওয়াসা, পিডিবি, পেট্রো বাংলা, বাপেক্সসহ প্রায় সব সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত কমিশন এবং প্রতিষ্ঠানে আইন কর্মকর্তা ও প্যানেল আইনজীবী হিসেবে আইনের ডিগ্রিধারীদের নিয়োগ লাভের অবারিত সুযোগ আছে।